আমরা সবাই হতভম্ভ হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।
ভাইয়া বলল, আমি কোলকাতায় খোজ নেবার চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। টী
ভাইয়া তোষক উল্টে পাসপোর্ট বের ককুল।
মা শোন, তুমি যে ভাব, বাবার ব্যাপারে আমার কোন মাথাব্যথা নেই, এটা ঠিক না। আমার কোন বন্ধুবান্ধব নেই মা। বাবা ছিলেন বন্ধুর মত। তুমি যতটুকু আগ্রহ নিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছ আমি তার চেয়ে কম আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি না। বাবা একদিন ফিরে আসবে এবং হাসতে হাসতে বলবে–ফানি ম্যান, ভেরী ফানি ম্যান। এটা শোনার জন্যে আমি কতটুকু ব্যস্ত তা তুমি কোনদিন বুঝবে না। আমি জ্বরে মরে যাচ্ছিলাম, তুমি দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলে। একবার
ভেতরেও ঢুকলে না। তোমার এই অপরাধ আমি কোনদিন ক্ষমা করব না বলে ভেবেছিলাম, মত পাল্টেছি। তোমাকে ক্ষমা করা হল। এখন তুমি ঘুমুতে যাও মা। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
মা ঘর থেকে চলে যাবার পর পর আমি বললাম, তুমি যে কথাটা বললে তা কি নিজে বিশ্বাস কর?
ভাইয়া রাগী গলায় বলল, বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস না করলে পাসপোর্ট করিয়েছি শুধু শুধু?
আমি নীচু গলায় বললাম, আমার কাছে একটা লোক এসেছিল সে …
ভাইয়া আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, চুপ কর। পাগলের মত কথা বলবি না। একজন একটা কথা বললেই বিশ্বাস করতে হবে?
সত্যি হতেও তো পারে।
ভাইয়া চোখ লাল করে বলল, যা তুই আমার সামনে থেকে। গেট আউট। গেট আউট।
মা ভাইয়ার চিক্কার শুনে ছুটে এসে বললেন, কি হয়েছে।
ভাইয়া হাসি মুখে বলল, কিছুই না। রেনুকে একটা হিটলারী ধমক দিয়ে দেখলাম–ধমক দিতে পারি কি–না। ভাল কথা মা তোমাদের বলতে ভুলে গেছি আমার একটা চাকরি হচ্ছে। দুলুর বাবা, মন্ত্রী সাহেব নিজেই আমাকে ডেকে চাকরি দিতে চেয়েছেন। ভাল একটা খবর ভেবেছিলাম চাকরি পাবার পর দেব। আগে ভাগেই দিয়ে ফেললাম। এখন দয়া করে একটু হাস মা। অনেকদিন তোমার মুখের হাসি দেখি না।
দ্বিতীয় দিনে ভাইয়ার জ্বর দুপুর বেলার দিকে খুব বাড়ল। একবার বমি করল। বমির সঙ্গে টাটকা রক্ত। আমি হকচকিয়ে বললাম, রক্ত কেন?
ভাইয়া বলল, টনসিল থেকে রক্ত আসছে। খামাখা মুখ এরকম করিস না। জ্বর নেমে যাচ্ছে।
সত্যি সত্যি বিকেলের দিকে জ্বর নেমে গেল।
ভাইয়ার অসুখের কথা কাউকে আমরা বলিনি কিন্তু দুলু আপা কোত্থেকে যেন খবর পেয়ে চলে এলেন। একবার ভাইয়ার ঘরে উঁকি দিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন।
অনেকদিন তুই আমাদের বাসায় আসিস না। কারণটা কি বল তো?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, মন্ত্রীর বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করে না। তবু একদিন গিয়েছিলাম। গেটে পুলিশ ধরল। হেন তেন কত প্রশ্ন। কার কাছে যাবেন? কেন যাবেন? শেষে রাগ করে চলে এসেছি।
দুলু আপা প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, দুদিন পর পর তোর ভাইয়ার জ্বর হয় কেন বল তো?
জানি না।
অকারণে রোদে ঘোরাঘুরি করে। জ্বর হবে না তো কি? আমি দুদিন দেখেছি, ঝঝ রোদে হাঁটছে। সঙ্গে পাগল ধরনের একজন মানুষ।
পাগল ধরনের না আপা। সত্যিকারের পাগল। ভাইয়া আজকাল পাগল ছাড়া কারো সঙ্গে মেশে না! তোমার সঙ্গে ভাইয়ার খুব ভাল মিল হবে। তুমিও পাগল।
দুলু আপার মুখ টকটকে লাল হয়ে গেল–খানিকটা লজ্জায়, খানিকটা আনন্দে।
পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে একটি মেয়ের লম্বা ও আনন্দ মেশানো লালচে মুখ। দুলু আপার দিকে তাকিয়ে থাকতে এত ভাল লাগছে।
আমি বললাম, আপা তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে এটা কি সত্যি?
মোটেই সত্যি না। আরেকটা কথা তোকে বলি–তুই যে আমাকে একবার বলেছিলি চিঠি লিখতে। আমি ঠিক করেছি লিখব।
খুব ভাল করেছ। আমার কাছে দিও। পৌঁছে দেব।
তোকে পৌঁছাতে হবে না। আমার চিঠি আমিই পৌঁছাব।
আমি বললাম, ভাইয়া জেগে আছে। আপা তুমি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করবে?
দুলু আপা দ্বিতীয়বার লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, না। আমি যাই রেনু। অের ভাইয়ার জ্বর বাড়লে আমাকে খবর দিস। মন্ত্রীর মেয়ে বলে অবহেলা করিস না।
ভাইয়ার জ্বরের তৃতীয় দিনের কথা। মা ঘরে নেই–তার এক মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছেন। সম্ভবত টাকা ধার করতে গেছেন। ঘরে একটি টাকাও নেই। আমিও আমার অভ্যাস মত ঘুরতে বের হয়েছি। হাঁটাহাঁটি করছি ঐ রাস্তায় যদি মবিনুর রহমান নামের মানুষটির দেখা পেয়ে যাই। একদিন না একদিন দেখা তো হবেই। এই দিকেই কোথাও তাঁর বাসা। এই রাস্তাতেই তাকে যাওয়া আসা করতে হয়। হাল ছেড়ে ঘরে বসে থাকার কোন মানে হয় না।
বাসায় আছে শুধু আপা একা। ভাইয়ার বেশ জ্বর। সে এই জ্বর নিয়েই আপার সঙ্গে হাসি তামাশা করছে। এক সময় বলল, মুখ ভর্তি দাড়ি গোফ–গাল চুলকাচ্ছে–মীরা, রেজারটা এনে দে, দাড়ি কামাব। আর শোন্ বাবার টু ইনওয়াল আয়নাটাও আন তো।
আপা রেজার এবং সাবান এনে দেখে ভাইয়া খাটের নীচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। আপা দরজা খুলে ছুটে বের হয়ে এল। কাঁদতে কাঁদতে সানগ্লাস পরা ছেলেটার কাছে গিয়ে বলল–আমার ভাইয়া মরে যাচ্ছে। আমার ভাইয়া মরে যাচ্ছে।
সানগ্লাস পরা ছেলে অসাধ্য সাধন করল। একা ভাইয়াকে কোলে নিয়ে বের হয়ে এল। বেবীটেক্সি করে নিয়ে গেল হাসপাতালে। হাসপাতালে আপা ক্রমাগত কাদছিল। ছেলেটা আপাকে প্রচণ্ড ধমক দিল–কান্নাকাটি করার এখন সময়? বিপদের সময় কান্নাকাটি–একেবারে অসহ্য। চুপ করেন তো।
ডাক্তাররা ভাইয়ার অসুখ ধরতে পারলেন না। তাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি অবশ্যি হল না। কারণ দুলু আপার বাবা (সেচ ও যোগাযোগ মন্ত্রী) দুবার এসে রুগীকে দেখে গেছেন। তাঁর নির্দেশে রুগীকে জেনারেল ওয়ার্ড থেকে কেবিনে নেয়া হয়েছে। চিকিৎসার জন্যে একটা মেডিকেল বোর্ড তৈরী করা হয়েছে।