এ জাতীয় কথায় আতংকগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক। আমরা আতংকগ্রস্ত হই। কিন্তু ভাইয়া নির্বিকার। সে হাসতে হাসতে বলল, যারা ঘন্টার পর ঘণ্টা পা ফাক করে দাঁড়িয়ে থাকে তাদেরকে ভয়ের কিছু নেই। এরা হামলেস ভেজিটেবল। কাজকর্ম নেই বলে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি ভাইয়াকে বললাম, তুমি তাদের কিছুই বলবে না?
কিছু বললে ওদের গুরুত্ব দেয়া হবে। এরা এটাই চাচ্ছে। কিছু না বলাই ভাল।
ওদের কাণ্ডকারখানা আমার কিন্তু ভাল লাগছে না। ওরা কোন একটা মতলব করছে।
মানুষের বাড়ির সামনে পা মেলে দাঁড়িয়ে কেউ মতলব করে না। তুই খামাখা চিন্তা করিস নাতো। চিন্তা করে কখনো কোন সমস্যার সমাধান হয় না।
অতি তুচ্ছ সব সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার কোন মানে হয় না। আমাদের সামনে বিশাল সমস্যা।
বিশাল সমস্যাটা কি?
যথাসময়ে জানতে পারবি।
এখনি বল।
ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাচ্ছি। ছোট খাট সব লক্ষণ আমার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে। রাস্তায় নামলেই পরিচিত লোকজনদের দেখি–যারা আসলে ত্রিসীমানায় নেই। যেমন গতকাল রেসকোর্সের পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি–পাবলিক লাইব্রেরীর দিকে, কি মনে করে ডান দিকে তাকালাম, দেখি সুলায়মান চাচা। রেসকোর্সের ভেতর একটা গাছের নীচে বসে আছেন।
কি বলছ তুমি?
হ্যাঁ তাই। বসে বসে বাদাম খাচ্ছেন। আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। প্রচণ্ড একটা শক খেলাম–ছুটে গেলাম, দেখি সুলায়মান চাচা না।
অন্য একজন।
এটাতো ভাইয়া এমন কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার না।
একবার ঘটলে অস্বাভাবিক না। বার বার ঘটলেই অস্বাভাবিক। আমি আভাকে দেখেছি তিনবার। অথচ কোন বারই আভা ছিল না। ছিল অন্য মহিলা। একবার দেখলাম আভা রিকশা করে যাচ্ছে–আমাকে দেখে ডাকল–এ্যাই এ্যাই। আমি রাস্তার ওপাশে ছিলাম, দৌড়ে পার হলাম–আরেকটু হলে একটা টেম্পোর নীচে পড়তাম। যাই হোক রাস্তা পার হয়ে দেখি অন্য মেয়ে। তারপর বাবার কথা ধর–বাবাকেতো প্রায়ই দেখি।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। সে সহজ গলায় বলল, নানান ঝামেলা এবং যন্ত্রণায় ব্রেইন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পাগলের সঙ্গে সব সময় ঘোরাঘুরি করি–সেটাও একটা ব্যাপার।
এখনও পাগলের সঙ্গে ঘোরাঘুরি কর?
হুঁ। করি। মানুষ হিসেবে এর অসাধারণ। অতি ভদ্র। আমি ওদের সঙ্গে জাপানী ভাষায় কথা বলি। ওরা এমন ভাব করে যেন কথা বুঝতে পারছে। কিছু কিছু আবার বুঝতেও পারে।
ভাইয়া চুপ করতো?
আচ্ছা যা চুপ করলাম।
চা খাবে? চা বানিয়ে আনব?
নিয়ে আয়।
আজ তুমি বেরুবে না?
না। শরীরটা ভাল লাগছে না।
চা এনে দেখি ভাইয়া চাদর গায়ে ঘুমুচ্ছে। তার গায়ে জ্বর। বেশ ভাল জ্বর।
বিকেলে জ্বর গায়েই সে বেরুল। টিউশানি আছে। ছাত্রের পরীক্ষা। টিউশানি মিস করলে সমস্যা হবে। ছাত্রের মা ভয়ংকর কড়া। এই টিউশনি হাত ছাড়া করা যাবে না। এরা টাকা ভাল দেয়। আমি বললাম, তুমি আমাকে ঠিকানা দাও ভাইয়া–আমি পড়িয়ে আসি। জ্বর গায়ে তুমি বেরুতে পারবে না।
ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, জ্বরকে পাত্তা দিলে জ্বর মাথায় চড়ে বসবে। অসুখ বিসুখ হলে এদের অগ্রাহ্য করতে হয়। অগ্রাহ্য করলে এরা লজ্জায় পালিয়ে যায়। এদের লজ্জা বেশী।
ভাইয়া রাতে প্রবল জ্বর নিয়ে ফিরল। কয়েকবার বমি করে নেতিয়ে পড়ল। আমি এবং আপা সারারাত জেগে রইলাম। মা দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেন–ভেতরে ঢুকলেন না। আশ্চর্য! এখনো তাঁর রাগ পড়ে নি। ঘরে থার্মোমিটার নেই, তাপ কত দেখতে পারছি না। ভাইয়া আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে আছে। মাঝে মাঝে চোখ মেলে তাকাচ্ছে। টকটকে লাল চোখ। ঠোঁট শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে কিন্তু মুখ হাসি হাসি।
আপা বলল, ভাইয়া কেমন লাগছে?
ভাইয়া বলল, কামিনারি দে দেতোও গা কিমাশিতা।
এর মানে কি?
মানে হচ্ছে–বজ্র পড়ায় বাতি নিভে গেলো।
ঘুমুতে চেষ্টা কর তো ভাইয়া।
চেষ্টা করছি, লাভ হচ্ছে না। পৃথিবী যে নিজের অক্ষের উপর ঘুরে এই ব্যাপারটা আগে বিশ্বাস করিনি। এখন করছি। আমার চারদিক বন বন করে ঘুরছে। জয় বিজ্ঞান।
আমি বললাম, চুপচাপ শুয়ে থাক।
ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, শুয়েই তো আছি দাঁড়িয়ে আছি নাকি?
শেষ রাতের দিকে ভাইয়ার জ্বর একটু নামল, সে বিছানায় উঠে বসল। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ট্রাবল দিয়েছি এখন ঘুমুতে যা।
শরীর ভাল লাগছে?
খানিকটা লাগছে। মা কি জেগে আছে?
হুঁ। বারান্দায় বসে আছেন।
মাকে ডেকে আনতো। মার রাগ ভাঙ্গাবার ব্যবস্থা করি।
মা ঘরে এলেন। ভাইয়া বলল, বসো মা।
মা বসলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর স্বাস্থ্য যে এতটা খারাপ হয়েছে আগে লক্ষ্য করিনি। ছায়ার মত একজন মানুষ। ভাইয়া হাত বাড়িয়ে মার হাত ধরল। মাকে টেনে পাশে বসিয়ে বলল, বাবা কোথায় আছেন এই সম্পর্কে অনেক চিন্তাচ ভাবনা করে একটা থিওবী বের করেছি। তোমাকে বলি শোন–বাবার একটা চিঠির কথা তোমার মনে আছে? যেখানে বেনাপোল বর্ডার দিয়ে সুপারি আসার কথা লেখা, ঐ চিঠি থেকে আমার ধারণা হয়েছে–বাবা বেনাপোল গিয়েছিলেন। তারপর লোভে লোভে বর্ডার ক্রস করেছেন। ব্যবসার জন্যেও যেতে পারেন আবার দেশ দেখার জন্যেও যেতে পারেন। তাঁর তো ঘোরার বাতিক আছে। ঐখানে ইণ্ডিয়ান পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। তারা বাবাকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। খবরের কাগজে দেখেছি কোলকাতার জেলে সত্তুর জনের মত বাংলাদেশী আছে। বিনা পাসপোর্টে যারা যায় তাদের ছমাসের মত জেল হয়। ছমাস প্রায় হতে চলল। আমার ধারণা, বাবার ফিরে আসার সময় হয়েছে।