খাবার টেবিলেও জাপানী ভাষা ছাড়া অন্য কোন কথা বলছে না।
বুঝলি খুকী, আমরা যেমন এক দুই করে জিনিস গুনি জাপানীরা তাই করে। তবে একেক রকম জিনিসের জন্যে একেক ধরনের এক দুই ব্যবহার করে। জাতি হিসেবে এরা খুব পাগলা।
তোমার কথা কিছুই বুঝলাম না।
সমতল জিনিস, যেমন–রুমাল, তক্তা এইসব গোনার জন্যে তাদের এক রকম সংখ্যা। এক হল ইচিমাই, দুই হল নিমাই, তিন হল সালমাই। আবার জন্তু এবং মাছ গোনার জন্য অন্য রকম সংখ্যা। এক হল ইপপিকি, দুই হল নিহিকি, তিন হল সানবিকি। লম্বা জিনিস যেমন–কলম, কলা, ছাতা এগুলি গোনার জন্য অন্য রকম সংখ্যা। এক হল ইপপেন, দুই হল নিহোন, তিন হল সানবোন।
পাগল নাকি?
অফকোর্স পাগল। ওরা যখন শুনে আমরা সব কিছু গোনার জন্যে এক দুই ব্যবহার করি এখন ওরাও চোখ কপালে তুলে বলে–পাগল নাকি হা-হা-হা।
মা এবং আপা কেউই ভাইয়ার এই সব আলাপে অংশ গ্রহণ করে না। আপা মাঝে মধ্যে কিছু বললেও মা কখনো বলেন না। ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। ভাইয়া বেশ কবার মিটমাটের চেষ্টা করেছে, লাভ হয়নি। মা আরো ঠাণ্ডা হয়ে গেছেন। বলা যেতে পারে বাসার পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক।
আপার টিচার তার দুই বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন। অনেকক্ষণ গল্প-টল্প করলেন। চা খেলেন। ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য প্রশ্ন করলেন। উত্তর যা পেলেন তার কোনটিই তাদের পছন্দ হল না। কিছু কিছু উত্তর শুনে রীতিমত ভুভুকে গেলেন। প্রশ্নের উত্তর বেশীর ভাগই দিল ভাইয়া। সে না দিয়ে যদি আমি দিতাম তাহলে হয়ত বা কিছুটা সামলে দিতাম। ভাইয়া সে সুযোগ দিল না। প্রশ্ন-উত্তরগুলি এরকম?
স্যার : এই বাড়ি কি আপনাদের নিজের?
ভাইয়া : পাগল হয়েছেন। ভাড়া বাড়ি। তাও অনেকদিন ভাড়া দেয়া হচ্ছে না। যে কোন মুহূর্তে বের করে দেবে।
স্যার : গ্রামের বাড়িতে নিশ্চয়ই জমিজমা আছে?
ভাইয়া : কিছুই নেই। সামান্য ছিল, বাবা তা বিক্রি করে ক্যাশ টাকা করেছিলেন ব্যবসার জন্যে। পাটের ব্যবসায় লাগানো হয়েছিল–লাভ হয়নি। আমও গেছে ছালাও গেছে।
স্যার : আপনার বাবা ব্যবসা করেন?
ভাইয়া : বাবা যা করেন তাকে ব্যবসা বলা ঠিক হবে না। তাতে ব্যবসা শব্দটার অমর্যাদা হবে। বাবাকে ভদ্র ফেরিওয়ালা বলতে পারেন। তিনি এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় আনেন।
স্যার : ইনি কি আছেন বাসায়?
ভাইয়া : না, উনি যে কোথায় আছেন আমরা জানি না! চার মাস ধরে বাড়ির সঙ্গে কোন যোগ নেই।
স্যার : (পুরোপুরি ঘাবড়ে গিয়ে) কেন?
ভাইয়া : বুঝতে পারছি না। সম্ভবত আমাদের পছন্দ করেন না।
এজাতীয় বাক্যালাপের পর বিয়ের কথা একশ হাত পানির নীচে চলে যাওয়ার কথা। গোলও তাই। ভদ্রলোক শুকনো মুখে চলে গেলেন।
আপা বলল, আবার আসবে। এক সপ্তাহের মধ্যে অসবে। কোন জায়গায় কিছু ঠিক করতে না পেরে আসবে।
ঠিক করতে পারবে না কেন?
চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝিস না কেন? ঘোড়ার মত মুখ। এই চিজকে কে শখ করে বিয়ে করবে? আমার কাছে আবার আসা ছাড়া গতি নেই। আবার আসবে। শেষ মুহূর্তে আসবে।
যদি আসে তুমি রাজি হবে?
জানিনা, হয়ত হব। এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না। পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। ঘোড়া টাইপ একটা ছেলেকে বিয়ে না করলে পালানো যাবে না।
তুমি এমন হয়ে যাচ্ছ কেন?
আপা সরু চোখে তাকাল।
সে আরো সুন্দর হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই সুন্দর হচ্ছে। এটাও আমাদের জন্যে ভয়ের কথা। সুন্দরী মেয়েদের সমস্যার অন্ত নেই। বাসার সামনে আজে বাজে ধরণের কিছু ছেলে এখন জটলা পায়। এর মধ্যে একজনকে দেখলে ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে মোটর সাইকেলে চড়ে আসে। মাথা ভর্তি বাড়ি চুল। চোখ সানগ্লাসে ঢাকা। সে একা আসে না। তার কোমর জড়িয়ে ধরে আরেকজন বসে থাকে। সেই জন রোগী টি টিঙে। সম্ভবত চামচা টাইপের কেউ। চোখে সানগ্লাসওয়ালা মোটর সাইকেল থেকে নেমে পা ফাঁক করে পঁড়ায়। চামচাটা পান এনে দেয় সিগারেট এনে দেয়। পাশে দাঁড়িয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসে।
আমাদের বাসটাই যে এদের লক্ষ্য তা অত্যন্ত পরিস্কার। কারণ এরা তাকিয়ে থাকে আমাদের বাসার দিকে। কোন কোন দিন দুটা মোটর সাইকেলে করে চারজন এসে উপস্থিত হয়। এরা কখনো বসে না। পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকে। সম্ভবত দাঁড়িয়ে থাকাটাই স্টাইল। এক বিকেলে সানগ্লাসওয়ালা আমাদের বাসার কড়া নাড়ল। আমি দরজা খুললাম। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে বললাম, কি চান?
সানগ্লাসওয়ালা বলল, আগুন দরকার। দেয়াশলাই আছে?
আমি দেয়াশলাই এনে দিলাম। সে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মীরা কি বাসায়?
হ্যাঁ বাসায়, কেন?
না এম্নি জিজ্ঞেস করলাম।
সে লম্বা লম্বা পা ফেলে মোটর সাইকেলের দিকে রওনা হল। আমি বললাম, দিয়াশলাই দিয়ে যান।
ও সরি, ক্যাচ ধরতো।
বলে দূর থেকে দেয়াশলাই ছুড়ে দিল। তার সঙ্গীরা হেসে উঠল। আমি কঠিন মুখ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এর বেশী আমার আর কি বা করার আছে। আমাদের পাশের বাড়ির ভাড়াটের স্ত্রী একদিন এসে কথায় কথায় আমার মাকে বললেন–আপা বড় মেয়েটাকে আপনি তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিন।
মা বললেন, কেন?
সবাই কি সব বলাবলি করে, শুনে ভয় লাগে শেষটায় যদি কোন কেলেংকারী হয়।
কি বলাবলি করে?
গুণ্ডা টাইপের ছেলে রোজ আসে। এদের বিশ্বাস নেই। ধরুন খালি বাসায় এরা যদি কোন দিন এসে মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তখন কি করবেন? এরকমতো হচ্ছে আজকাল। খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়–অপহরণ, ধর্ষন। আপা, আপনি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করুন কিংবা দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিন।