কে নিতে এসেছে?
সুলায়মান চাচার বড় মেয়ে। চাচার শরীর খুব খারাপ। তোকে আর ভাইয়াকে নিতে এসেছে। তোদের দেখতে চেয়েছেন। ভাইয়া বাসায় নেই। তুই যা।
আমি বিছানা ছেড়ে নামলাম। হাত মুখ ধুতে বারান্দায় গিয়ে দেখি সুলায়মান চাচার বড় মেয়ে মোড়ায় বসে আছেন। ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন। আমাকে দেখে ভাঙ্গা গলায় বললেন–তাড়াতাড়ি কর রেনু।
সুলায়মান চাচা মারা গেলেন ঠিক সন্ধ্যায়। ঘরে তখন শুধু আমি একা। সুলায়মান চাচা ইশারায় সবাইকে চলে যেতে বলেছিলেন। ঘরে কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর কাছে যেতে বললেন। আমি কাছে গেলাম। তাঁর হাত ধরে পাশে দাঁড়ালাম। তিনি কিছু একটা বলতে চাইলেন। বলতে পারলেন না। মৃত্যু সম্পর্কে অনেককে বলতে শুনেছি–মানুষ কখন মারা যায় বুঝা যায় না, এমন কি ডাক্তাররাও ধরতে পারেন না। পরীক্ষা টরীক্ষা করে বলতে হয় রোগী মৃত। আমার ধারণা কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। যেই মুহূর্তে সুলায়মান চাচা মারা গেলেন আমি টের পেলাম। তারপরেও অনেকক্ষণ তার হাত ধরে বসে রইলাম। একটা মানুষ কত ভাল ছিল তা টের পাওয়া যায় মৃত্যুর পর। আমি তো খুব বেশী মানুষের সঙ্গে মিশিনি। আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটি মারা গেলেন আমার চোখের সামনে। আমার কাঁদা উচিত। কাঁদতে পারছি না। দুঃখে হৃদয় অভিভূত হওয়া উচিত। তাও হচ্ছে না। আমি শান্ত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ক্লিনিকের বারান্দায় সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আমি শান্ত মুখে বললাম, যান, আপনারা ভেতরে যান।
বড় মেয়ে আগ্রহ নিয়ে বললেন, বাবা কেমন আছেন?
আমি কিছু না ভেবেই বললাম, ভাল।
ঐ দিন সন্ধ্যা আমার জীবনের একটা বিশেষ সময়।
কাজেই আমি আপনাকে অনুরোধ করছি এখন যা বলব, খুব মন নিয়ে শোনার জন্য। আমি ক্লিনিক থেকে বের হলাম। রিকশা নিতে যাব–মনে হল–আসার সময় টাকা নিয়ে আসিনি। তাতে অসুবিধা নেই। একটা রিকশা নিয়ে বাসায় যেতে পারি। কিন্তু বাসায় পৌঁছে যদি দেখি–মার কাছে টাকা নেই।
পথ খুব বেশী না। এক মাইলেরও কম হবে। অনায়াসেই হেঁটে যাওয়া যায়। রাস্তাভর্তি লোকজন। সোডিয়াম লাইট জ্বলছে। অসুবিধা কি? আমি হাঁটতে শুরু করলাম। মগবাজার চৌরাস্তায় পোঁছতেই একজন নিতান্ত অপরিচিত লোক আশাকে পেছন থেকে ডাকল–রেনু, এই রেনু।
আমি চমকে পেছনে ফিরে দেখি রিকশায় ৩০/৩৫ বছরের এক ভদ্রলোক বসে আছেন। দুহাতে দুটা বাজারের ব্যাগ। পায়ের কাছে ধবধবে শাদা রঙের একটা হাস। ভদ্রলোকের চেহারার বর্ণনা দেই–খুব সাধারণ চেহারা। তবে বড় বড় চোখ। চোখের দিকে তাকালে কাজি নজরুল, কাজি নজরুল মনে হয়। কাজি নজরুল মনে হওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে তাঁর মাথার চুল লম্বা। ফ্যাশনের লস্য না। অনেকদিন চুল না কাটলে চুল যেমন ঝাকড়া ঝাকড়া হয়ে যায় তেমন। তাঁর গায়ে খয়েরী রঙের সার্ট।
আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোক বিরক্ত গলায় বললেন, কি যন্ত্রণায় পড়েছি দেখ তো রেনু। রিকশার চাকা বাস্ট হয়েছে। বাজারের ব্যাগ একটা ফুটো হয়েছে। টপ টপ করে গোল আলু পড়ছে। হাঁস একটা কিনেছি। ব্যাটা ঠিকমত বেঁধে দেয় নি। উড়ে যাবার চেষ্টা করছে। হাঁসটাকে পা দিয়ে চেপে ধরে রাখতে হচ্ছে।
আমি বললাম, আপনাকে কিন্তু আমি চিনতে পারছি না।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, আমাকে চিনতে পারছ না মানে? তুমি রেনু না?
জ্বি।
আমি মবিন। মবিনুর রহমান।
আমি এখনো চিনতে পারছি না।
বল কি। তুমি কলাবাগানে থাক না?
জ্বি–না?
তুমি আউয়াল সাহেবের মেয়ে না?
জ্বি–না।
ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে গেলেন। আমি নিজেও বিস্মিত। তিনি যে মেয়েকে চেনেন সে নিশ্চয়ই দেখতে আমার মত। তার নামও রেনু। এমন মিলের কোন মানে হয়?
ভদ্রলোক বললেন, আমি অসম্ভব রকম লজ্জিত। তুমি কিছু মনে করো না। একবার তুমি বলে ফেলেছি বলেই এখনো বলছি। নয়ত বলতাম না। মাই গড। হোয়াট এ মিসটেক!
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি কিছু মনে করি নি।
ভদ্রলাকে বললেন, আমি যে মেয়ের কথা বলছি–সে দেখতে অবিকল তোমার মত। আমি যে ভুল করেছি সেই ভুল ঐ মেয়েকে যারা চেনে তারা সবাই করবে। তুমি বিশ্বাস কর আমার কথা।
আপনাকে এত লজ্জায় পড়তে হবে না। আমি কিছু মনে করি নি। আচ্ছা যাই? আপনার হাঁসটা কিন্তু পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। ভাল করে চেপে ধরুন।
আমি হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এসে একবার পেছনে ফিরলাম। ভদ্রলোক রিকশা থেকে নেমেছেন। হাতে ব্যাগ বা হাঁস কিছুই নেই। তাঁর পলকহীন দৃষ্টি আমার দিকে। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল তিনি লজ্জায় পাথর হয়ে গেছেন।
সেই রাতে আমার একফোঁটা ঘুম হল না। তার কারণ সুলায়মান চাচার মৃত্যু নয়। কারণ পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকা ঐ ভদ্রলোক। সারাক্ষণ ঐ ছবি আমার মনে পড়তে লাগল। শেষ রাতে সামান্য তন্দ্রার মত এল–তখনি ভদ্রলোককে স্বপ্নে দেখলাম। তিনি দুটি রাজহাঁস নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। দরজার কড়া নাড়লেন। আমি দরজা খুললাম। ভদ্রলোক বললেন, রেনু দুটা রাজহাঁস নিয়ে এসেছি। দেখ তো পছন্দ হয় কি-না।
আমি বললাম, আপনি কে? আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
ভদ্রলোক আহত ও অপমানিত গলায় বললেন, কি বলছ তুমি?
আমি আপনার নামও তো জানি না।
আমার নাম মবিন। মবিনুর রহমান।
এই নামে আমি কাউকে চিনি না। প্লীজ আপনি যান তো।
আচ্ছা যাচ্ছি। হাঁস দুটা রেখে দাও।
ভদ্রলোক হাঁস দুটা ঘরের ভেতর ছেড়ে দিলেন। তারা প্যাক প্যাক করে সারা ঘরময় ছুটে বেড়াতে লাগল। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।