বাবা গৃহত্যাগ করেন নি। উনি গৃহত্যাগের মানুষ না। খুব ঘরোয়া মানুষ। ব্যবসায়ের কারণে বাইরে যেতেন। যে কদিন বাইরে থাকতেন ছটফট করতেন।
মানুষকে এত চট করে বোঝা যায় না রে রেনু। মানুষ খুব জটিল বস্তু। গৌতম বুদ্ধও তো সংসারী মানুষ ছিলেন। তাঁর ছিল পরমা সুন্দরী স্ত্রী যশোধারা। চাঁদের মত ছেলে ছিল–রাহুল। ছেলেকে এক মিনিট চোখের আড়াল করতেন না। সেই গৌতম বুদ্ধও কি ঘুমন্ত স্ত্রী-পুত্র রেখে পালিয়ে যাননি?
বাবা গৌতম বুদ্ধ না চাচা। একজন অতি সামান্য ব্যবসায়ী। যাকে জীবিকার জন্যে সামায়িকভাবে গৃহত্যাগ করতে হত।
আর একটা ভুল কথা বললি রেনু। সব মানুষের মধ্যেই গৌতম বুদ্ধের বীজ থাকে। সময়মত পানি পায় না বলে বীজ থেকে গাছ হয় না। তুই যখন রাস্তায় হাঁটবি চোখ কান খোলা রেখে হাঁটবি। আমি নিশ্চিত অনেকবার তোর সঙ্গে তোর বাবার দেখা হয়েছে, তুই খেয়াল করিস নি।
আমি সব সময়ই চোখ কান খোলা রেখে হাঁটতাম। বাবা নিখোজ হবার পর তা আরো বেড়েছে। তাতে কোন লাভ হয় নি। তবে কেন জানি আমার নিজের মধ্যেই একটা ক্ষীণ আশা একদিন পেছন থেকে বাবা ডেকে উঠবেন–কে যাচ্ছে, রেনু না?
আমি থমকে দাঁড়াব। বাবা হতভম্ব গলায় বলবেন–শাড়ি পরে যাচ্ছিলি, আমি তো চিনতেই পারি নি। শাড়ি পরছিস কবে থেকে?
অল্পদিন থেকে পরছি। ঘরে পরি না। বাইরে বের হলে পরি।
সুন্দর লাগছে। আচ্ছা কিনে দেব। ভাল শাড়ি কিনে দেব। চল এখনি কিনে দি। কিছু টাকা সঙ্গে আছে।
শাড়ি কিনতে হবে না বাবা, তুমি আমার সঙ্গে চল তো।
কোথায় যাব?
বাসায়। আবার কোথায়? তোমার যে ঘর বাড়ি আছে এটা কি তোমার মনে নেই?
হুঁ। ভাল কথা বলেছিস। আসলে ব্যাপারটা কি জানিস…
আসল ব্যাপারটা কি?
বাবা বিব্রত ভঙ্গিতে হাসতে থাকেন। আমি তাঁর হাত ধরি। কল্পনা এই পর্যন্ত। মানুষের কল্পনারও সীমা থাকে। আমার তো মনে হয় না কেউ কখনো কল্পনা করে সে উড়তে পারে। আকাশে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কল্পনাকেও যুক্তির ভেতর থাকতে হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কল্পনাশক্তিও কমতে থাকে। একটা সময় আসে যখন মানুষ কল্পনা করে না। আমার মার বোধ হয় সেই সময় যাচ্ছে। তিনি তাকিয়ে থাকেন শূন্য চোখে। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে কি যেন বলেন। আমি একদিন বললাম, মা তুমি কি বলছ? তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, কই কিছু বলছি না তো।
আমাদের বড় আপার মৃত্যুদিন গেল গত পরশু। আমরা সবাই খুব আতংকগ্রস্ত ছিলাম মা না জানি কি করেন। তিনি কিছুই করলেন না। নিতান্তই স্বাভাবিক আচরণ করলেন। সব বার শোকের এই তীব্র দিনটিতে বাবা-মা এক সঙ্গে থাকেন। এবার মা একা। এবং তাঁর মধ্যে কোন বিকার নেই। নামাজে অন্য দিনটিতে যতটা সময় দেন, আজও তাই দিলেন। সন্ধ্যার পর বারান্দায় এসে বসলেন। আপাকে বললেন, মীরা আমাকে এক কাপ চা দিবি না। তাঁকে চা দেয়া হল। তিনি চা খেলেন। রাতের খাবারও খেলেন নিঃশব্দে। এর আগে কোনদিন তাঁকে রাতে কিছু খেতে দেখিনি। রাত দশটার দিকে ঘুমুতে গেলেন। আপা আমাকে ডেকে বললেন–তুই মার সঙ্গে ঘুমে। কোন সমস্যা হলে আমাকে ডাকবি। আমি জেগে আছি।
মা থাকতে দেবে না। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখ
আমি বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, মা তোমার সঙ্গে ঘুমুব। মা তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে বললেন, আয়।
আমি ঘরে ঢুকলাম, মার পাশে শুয়ে পড়লাম। মা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন–তোর তো কলেজ বন্ধ, তুই সারাদিন কি করিস? আমি হকচকিয়ে গেলাম। ক্ষীণ স্বরে বললাম, কলেজ বন্ধের কথা তোমাকে কে বলল?
আমি জানি।
কবে জানলে?
অনেক দিন আগেই জানি। তুই কি কারো বাসায় যাস?
না।
রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়াস?
হুঁ।
তোর বাবাকে খুঁজিস?
আমি জবাব দিলাম না। মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আর হাঁটাহাঁটির দরকার নেই। তোর বাবা ফিরে আসবেন না। উনি জীবিত নেই।
কি বলছ মা?
জীবিত থাকলে আজকের দিনে চলে আসত। আজ যখন আসেনি আর কোনদিনও আসবে না। তুই ঘুমো তো রেনু। রোদে ঘুরে ঘুরে কি কালো হয়ে শেছিস। আয়নায় নিজেকে দেখিস না? এখনি তো সুন্দর হওয়ার বয়স!
মা এমন কোন আবেগের কথা বলছেন না। সহজ স্বাভাবিক কথা। কিন্তু আমার কান্না পেয়ে গেল। আমি নিঃশব্দে কাঁদছি। এমন ভাবে কাঁদছি যেন মা কিছুতেই বুঝতে না পারেন।
রেনু!
জি।
তোর বড় আপার জন্য আমি নিজের হাতে একটা জামা বানিয়েছিলাম। টকটকে লাল সিল্কের জামা। ঐ জামাটা তোর বাবা তার ব্রীফকেসে কাগজ পত্রের নীচে লুকিয়ে রাখে–বছরের মাত্র একদিন গভীর রাতে জামাটা বের কর। হয়। আজ সেই রাত। তোর বড় আপাকে লোকটা কোনদিন দেখে নি–কিন্তু..
বাদ দাও।
কত যে কল্পনা ছিল অরুকে নিয়ে। দরিদ্র মানুষ–জিনিসপত্র কিনে বাড়ি টী গোসল দেবার জন্য লাল প্লাস্টিকের গামলা। মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সব বিলিয়ে দেয়।
মা, আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না।
এই যে তোর বাবা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, ঠিক যে ব্যবসায়ের কারণে ঘুরে বেড়ায় তা কিন্তু না। ঘরে তার মন টিকে না। কিছুদিন ঘরে থাকলেই সে অস্থির হয়ে উঠে। অরু বেঁচে থাকলে–এ রকম হত না। মানুষটা ঘরেই থাকত।
মা ঘুমাও।
মা পাশ ফিরলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম।
ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যা সন্ধ্যায়। নিজ থেকে ভাঙ্গল না। আপা এসে ধাক্কা দিয়ে তুলল। শংকিত গলায় বলল, তোকে নিতে এসেছে, তাড়াতাড়ি উঠ।