তোমাকে কে বলল?
আমার তাই ধারণা। দেখিস না আমি কেমন চট করে ঘুমিয়ে পড়ি। বাবাও তাই। বাবার ঘুমের সমস্যার কথা কখনো শুনেছিস? শোয়ামাত্র ঘুম। বাবাকে কখনো দেখেছিস ঘুম হচ্ছে না বলে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে?
না।
মিলল আমার কথা?
আমি জবাব দিলাম না। আপা মৃদুলায় বলল–দুলুর কথা ধর। এই মেয়ে কি রাতে ঘুমায়? আমার তো মনে হয় জেগেই কাটায়। অথচ ওর বাংলাদেশে কটা আছে?
কথা শেষ করে আপা পাশ ফিরল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। আমি সম্ভবত সুখী মেয়ে। জেগে রইলাম। দুলু আপাও জেগে আছে। তাকে আগের রোগে ধরেছে। ক্রমাগত গান বাজিয়ে যাচ্ছে। একই গান–বার বার শুনলে গানটা আর গান থাকে না। মন্ত্রের মত হয়ে যায়। শেষের দিকে মনে হয় কে যেন কানের কাছে মন্ত্র পাঠ করছে :
যায় দিন, শ্রাবণ দিন যায়
আঁধারিল মন মোর আশঙ্কায়
মিলনের বৃথা প্রত্যাশায়
যায় দিন, শ্রাবণ দিন যায় …
আমি আধোঘুম আধো জাগরণে মন্ত্রপাঠ শুনতে লাগললাম।
সুখী মেয়েরা রাস্তায় কি ভাবে হাঁটে আপনি জানেন? জানেন না? আমিও জানি না কিন্তু হাঁটতে চেষ্টা করি সুখী মেয়ের মত। ভাব করি যেন হাঁটতে খুব ভাল লাগছে, যা দেখছি তাতেই মুগ্ধ হচ্ছি। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে বাসায় বলিনি। ঠিক নটায় তাড়াহুড়া করে বই খাতা সঙ্গে নিয়ে বের হই। বেরুবার আগে মার সামনে যাই। নীচু গলায় বলি–টাকা দিতে পারবে? না পারলে অসুবিধা নেই।
মা পাঁচ টাকার একটা নেটি এগিয়ে দেন। কোথেকে দেন কে জানে। বেশীর ভাগ দিন এই নোটটা খরচ হয় না। হেঁটে বেড়ালে টাকা খরচ হবে কেন? ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কোন একটা রেকর্ডের দোকানে ঢুকি। খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলি, সতীনাথের পুরানো গানের একটা ক্যাসেট অতি দ্রুত করে দিতে পারেন? আমার এখনি দরকার। আমি এক্সট্রা পে করতে রাজি আছি। দোকানদার হাই তুলতে তুলতে বলে–এক সপ্তাহের আগে সম্ভব হবে না। হেভী বুকিং।
বাড়তি টাকা দিলেও হবে না?
আর্জেন্ট করে দিতে পারি। ডাবল পেমেন্ট। তাও আজ পাবেন না। দুদিন লাগবে।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত হবার ভঙ্গি করে বলি, তা হলে তো হচ্ছে না। আচ্ছা, সতীনাথের ঐ গানটা একটু বাজান তো শুনি–এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনাতো মন।
দোকানদার নিতান্ত অনিচ্ছায় খানিকটা বাজায়। বাজাতে বাজাতে হাই তুলে। ক্যাসেটের দোকানের লোকজন ক্রমাগত হাই তুলে কেন কে জানে। আমি যে কট্রা দোকানে গেছি সব জায়গায় এক অবস্থা–এরা হাই না তুলে কথা বলতে পারে না। কথা বলেও কম। রাণীক্ষেত রোগ হলে মুরগীরা যেমন ঝিম ধরে থাকে এরাও সে রকম। সারাক্ষণ ঝিম ধরে আছে।
দুপুরের পর হাঁটতে ভাল লাগে না। বাসায় ফিরে আসি। গোসল করে লম্বা একটা ঘুম দেই। সুলায়মান চাচাকে দেখতে যাই না কারণ তাঁর মেয়েরা খোজ পেয়ে গেছে। তারা সারাক্ষণ বাবাকে ঘিরে থাকে। যে দুবার গিয়েছিলাম এমন করে তাকিয়েছে যেন আমি রক্তচোষা ড্রাকুলা। তার বাবার রক্ত খাবার জন্যে আসি।
হাসপাতালেই সবচে ছোট মেয়েটি আমাকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলল, বাড়ি ছাড়ার জন্যে আপনাদের এক মাস সময় দেয়া হয়েছিল। মাস প্রায় শেষ হতে চলল। আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম। আমার স্মৃতি শক্তি ভাল না।
আমি বললাম, মনে করিয়ে খুব ভাল করেছেন। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
অন্য তিনজন ভাড়াটের মধ্যে দুজন চলে গেছে। আর একজন যাবে এই শুক্রবারে।
ও আচ্ছা।
বাড়িটা আমাদের খুব জরুরী ভাবে দরকার।
ভাইয়াকে বলব। ঐ তে গার্জিয়নি।
সুলায়মান চাচাকে দেখতে যেতে ভাল না লাগার আরেকটা কারণ হচ্ছে তিনি এখন কথাবার্তা একেবারেই বলেন না। তাঁর শরীর দ্রুত খারাপ হয়েছে। চোখ গাঢ় হলুদ। নিঃশ্বাস ফেলার সময় অদ্ভুত শব্দ হয়। আমার দিকে এমনভাবে তাকান যেন চিনতে পারছেন না। তবে চলে আসবার সময় মেয়েদের বলেন–রেনুর হাতে কুড়িটা টাকা দাও তো। রিক্সাভাড়া।
মেয়েরা তৎক্ষণাৎ বলে, দিচ্ছি।
কিন্তু দেয় না। বরং এমন ভঙ্গি করে যে আমার বলতে ইচ্ছা করে, কিছু দিতে হবে না। আমার কাছে একটা পাঁচ টাকার নোট আছে। আপনি দয়া করে রেখে দিন।
ডাক্তাররা সুলায়মান চাচার ব্যাপারে জবাব দিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়। তাঁর শরীরের কোন যন্ত্রপাতিই এখন কাজ করছে না। লিভার কাজ করছে না, কিডনি কাজ করছে না, শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। মাথার চুলও উঠতে শুরু করেছে। হাসপাতালে ঢােকার আগে কিছু চুল ছিল। এখন মাথা প্রায় ফাঁকা। কথাবার্তাও অসংলগ্ন। এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে এমন ভাবে যান যে খটকা লাগে।
ঐ দিন শীত নিয়ে কথা হচ্ছে। শেষ রাতে নাকি তার খুব শীত লাগে। আবার গায়ে চাদর দিলে গরম লাগে।
এই প্রসঙ্গে বলতে বলতে হঠাৎ বললেন, রেনু তোর বাবা কাজটা ভালই করেছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কোন কাজ?
এই যে লুকিয়ে আছে। আমার কি ধারণা জানিস? আমার ধারণা উনি কোথাও ঘাপটি মেরে আছেন। বেশী দূরে না, কাছেই। তোদের আশেপাশে যাতে তোদের উপর লক্ষ্য রাখতে পারেন। এক সময় বের হবেন–তোদের চমকে দেবেন।
আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম, এই প্রসঙ্গ থাক চাচা। আচ্ছা থাক। তবে আমি কিন্তু ভুল বলছি না। যা বললাম আমার মনের কথা। তোর বাবা যে কাজটা করেছেন–আমার এমন একটা কাজ করার ইচ্ছা সারা জীবন ছিল। করতে পারিনি। সাহসের অভাবে পারিনি। গৃহত্যাগ করা সহজ ব্যাপার না। মহাপুরুষ ছাড়া কেউ পারেন না।