খানিকক্ষণ আর কোন কথাবার্তা শোনা গেল না। ভদ্রলোকের হয়ত ভাইয়ার কথাগুলি হজম করতে সময় লাগছে। সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। এমন কঠিন কথার চট করে জবাব দেয়া যায় না। জবাবটা কি হয় শোনার জন্য অপেক্ষা করছি, রেগে আগুন হয়ে একটা কঠিন জবাব দেবার কথা। ভদ্রলোক তা দিলেন। না। তিনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন, রঞ্জু সাহেব যেসব আইনকানুনের কথা বললেন–তা সবই আমি জানি। তারপরেও বলছি সাতদিনের মৌখিক নোটিশে আপনাকে উচ্ছেদ করা আমার পক্ষে কোন সমস্যাই নয়। সাতদিনও খুব বেশী সময়। যাই হোক শুরুতে আমার স্ত্রী এক মাসের কথা বলেছে। কাজেই একমাসই বহাল রইল। আপনি একমাস পর বাড়ি ছেড়ে দেবেন।
যদি না ছাড়ি?
আপনি বুদ্ধিমান লোক। ভুল করবেন বলে মনে হয় না। আচ্ছা ভাই–যাই। এত রাতে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।
ভাইয়া গম্ভীর মুখে ভাত খেতে এল। মা বললেন, কি হয়েছে রে রঞ্জু? ভাইয়া শুকনো গলায় বলল, কিছু হয় নি।
ঐ ভদ্রলোক তোকে কি বলল? তেমন কিছু বলে নি।
তেমন কিছু বলেনি তাহলে তুই এমন গম্ভীর হয়ে আছিস কেন? তোর বাবা সম্পর্কে কিছু বলেছে?
ভাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, বাবা সম্পর্কে কিছু বলেনি। তোমার কি ধারণা পৃথিবীর সবাই বাবা সম্পর্কে আলোচনা করে? এইটাই কি তাদের কথা বলার একমাত্র বিষয়?
তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি কি তোর বাবার কথা তুলে কোন অন্যায় করেছি?
আরে, কোন কথা থেকে কোন্ কথায় আসছ–ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন আসছে কেন?
আমি লক্ষ্য করেছি–তোর বাবার বিষয়ে কিছু বললেই তুই রেগে যাস।
রেগে যাই না মা, বিরক্ত হই। দিনের মধ্যে এক হাজার বার জিজ্ঞেস কর তোর বাবার কোন খোজ পেলি। কি যন্ত্রণা খোঁজ পেলে আমি বলব না?
তোর বাবার কথা জিজ্ঞেস করা কি অপরাধ?
ভাইয়া খাওয়া বন্ধ করে, প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়াল। মা শান্ত গলায় বললেন, ভাত খা রঞ্জু। আমি আর কোনদিন তোর বাবার প্রসঙ্গ তুলব না।
মার কথায় ভুইয়া হকচকিয়ে গেল। আবার চেয়ারে বসল। কিন্তু কিছু খেতে পারল না। অতি অল্প সময়ে খুব বড় ধরনের একটা নাটক আমাদের বাসায় হয়ে গেল। মাকে আমি চিনি–মা আর কোনদিনই বাবার প্রসঙ্গ তুলবে না।
সে রাতে ভাইয়া সকাল সকাল দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল। মার ঘরে গিয়ে দেখি মাও শুয়ে পড়েছেন। কয়েকবার ডাকলাম–মা সাড়া দিলেন না। গেলাম আপার ঘরে। আপা বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল। কিংবা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই তাকাল কিন্তু আমার কাছে মনে হল খুব বিরক্ত। কারণ ইদানীং সারাক্ষণ সে বিরক্ত ভাব করে ঘরে বসে থাকে।
আপা তোমার সঙ্গে ঘুমতে হবে।
কেন?
ভাইয়া, মা দুজনই দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। তুমি কি জায়গা দেবে?
এটা কেমন কথা জায়গা দেব না কেন?
আমি বিছানায় উঠতে উঠতে বললাম, কি বিশ্রী ব্যাপার হল আপা দেখেছ? ভাইয়া এটা কি করল?
আপা ঠাণ্ডা গলায় বলল, সবে শুরু। আরো কত খারাপ ব্যাপার হবে দেখবি।
কি রকম খারাপ ব্যাপার?।
এতদিনে যখন বাবার খোঁজ পাওয়া যায় নি–আর যাবেও না। ভাইয়া অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও চাকরি পাবে না। আমাদের এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। মার শরীর খুব খারাপ হবে। নানা রোগ-ব্যাধিতে ভুগবেন কিন্তু মরবেন না। বেঁচে থাকবেন। আশায় আশায় বাঁচবেন। বাবা একদিন ফিরে আসবেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হবে এই আশায় বেঁচে থাকা। রেনু। আমাদের সামনে ভয়ংকর সব সমস্যা।
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, তুমি কি এসব নিয়ে খুব চিন্তা কর?
না।
আপা শোবার আয়োজন করল। বাতি নিভিয়ে দিল। আমি বললাম, মাশারি খাটাবে না? খুব মশা তো।
মশারির ভেতর আমার ঘুম আসে না। দমবন্ধ লাগে। এই জন্যেই তো একা থাকতে চাই। কাউকে সঙ্গে রাখতে চাই না।
তোমাকে মশায় কামড়ায় না?
খুব কম কামড়ায়। ফর্সা মানুষদের মশা কামড়ায় না। তোকে কামড়াবে। আমাকে না। মশাদের সৌন্দর্যবোধ প্রবল …।
বলতে বলতে আপা হাসল। অনেকদিন পর আমি আপাকে হাসতে শুনলাম। আপা আমার গায়ে হাত রেখে বলল, রেনু তোদের রেখে আমি যদি চলে যাই। তোরা রাগ করিস না।
আমি চমকে উঠে বললাম, কোথায় যাবে?
দেশের বাইরে। আমাদের একজন টিচার আছেন যাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় আমার প্রতি তাঁর খানিকটা আগ্রহ আছে। তিনি স্কলারশীপ নিয়ে বাইরে যাচ্ছেন। আমাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে বাইরে যাবার কথা খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন। তারপর হঠাৎ আমাদের বাসার ঠিকানা চাইলেন।
তুমি কি উনাকে পছন্দ কর?
না।
একেবারেই না?
একেবারেই না। কিছু মানুষ আছে যাদের দেখলে মনের উপর অসম্ভব চাপ পড়ে–ঐ লোকটি হচ্ছে সে রকম। এরা কি করে জানিস? এরা খুব হিসেব করে আগায়। বিয়ের ব্যাপারটাই ধর–এরা চায় সবচে সুন্দরী মেয়েটাকে বিয়ে করতে। মেয়ে শুধু সুন্দরী হলে হবে না, পড়াশোনায় ভাল হতে হবে, বাবার প্রচুর টাকা থাকতে হবে।
উনি তেমন নাও তো হতে পারেন।
সেই সম্ভাবনা খুব কম। ঐ লোক আমাকে ছাড়াও আমার জানামতে আরে৷ তিনটি মেয়ের ঠিকানা নিয়েছে। তিনজনই রূপবতী। সে এদের প্রত্যেকের বাসায় যাবে। হিসাব নিকাশ করবে। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকব আমি।
তুমি টিকে থাকবে কেন?
আমার সে রকমই মনে হচ্ছে। আমি কিছু কিছু জিনিস আগে আগে বুঝতে পারি। আর কথা বলতে ভাল লাগছে না, ঘুমুতে চেষ্টা কর।
চেষ্টা করেও লাভ নেই আপা, আমার সহজে ঘুম আসে না।
আপা আবার হাসল। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হাসছ কেন?
আপা বলল, যাদের মাথায় রাজ্যের চিন্তা তারা বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। প্রকৃতি তাদের ঘুম পাড়িয়ে চিন্তামুক্ত করে। যারা সুখী মানুষ তারাই সহজে ঘুমুতে পারে না। বিছানায় গড়াগড়ি করে।