একজন মানুষ মারা যাচ্ছে আর এক গাদা লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি সেই একগাদা মানুষের একজন–সেই কথা বলছি না। একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, আপনি তার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরে আর কেউ নেই। এমন অবস্থা কি আপনার জীবনে হয়েছে?
আমার হয়েছে।
সুলায়মান চাচার মৃত্যুর সময় আমি তাঁর পাশে! ঘরে আর কেউ নেই। মৃত্যু মুহূর্তে আমি তাঁর হাত ধরে বসে আছি। ব্যাপারটা ভাল করে গুছিয়ে বলি। চাচার শরীর খুব যখন খারাপ হল তখন তিনি ভাইয়াকে বললেন, তাঁকে কোন একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিতে। ভর্তিটা করাতে হবে গোপনে যেন তাঁর তিন মেয়ে কিছুই জানতে না পারে।
ভাইয়া বলল, সেটা কি ঠিক হবে চাচা?
খুব ঠিক হবে। ওদের না দেখলে আমি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকব। দেখলে আর বাঁচব না। তুমি আমাকে শহর থেকে দূরে কোন ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দাও। এই কাজটা কর।
ভাইয়া তাঁকে শহরের একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এল। সুলায়মান চাচা ক্লিনিকে যাবার আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন। তাঁর বাসার কাজের মানুষ দুজনকে বেতন ছাড়াও এক হাজার করে টাকা দিয়ে বিদেয় দেয়। হল। ওদের বললেন, তোরা দুজনই দু হাতে চুরি করেছিস। সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম। আমিও তোদের বকাঝকা যা করেছি তা মনে রাখিস না।
ভাইয়াকে বললেন, বাড়ি বাবদ তোমার কাছে অনেক টাকা পাওনা। সেগুলি ক্ষমা করে দিলাম। তার বদলে তুমি প্রতিদিন একবার হাসপাতালে আমাকে দেখতে যাবে।
ভাইয়া বলল, নিতান্তই অসম্ভব। হাসপাতাল আমি সহ্যই করতে পারি না। তাছাড়া প্রতিদিন যে যাব–রিকশা ভাড়া পাবো কোথায়?
রিকশা ভাড়া আমি দেব। যতবার যাবে কুড়ি টাকা করে রিকশা ভাড়া পাবে।
নানান ধান্ধায় থাকি চাচা। রোজ যেতে পারব না তবে প্রায়ই যাব। রেনু যাবে।
আমি যে কোথায় আছি তা যেন ভুলেও প্রকাশ না হয়।
প্রকাশ হবে না।
সুলায়মান চাচাকে ঢাকা শহরের মাঝখানে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল। উনি গেলেন খুব হাসি মুখে। যেন পিকনিক করতে যাচ্ছেন কিংবা ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন। তাঁর ঘরের দরজায় বিশাল তালা লাগিয়ে চাবি আমাকে দিয়ে গেলেন।
কাউকে চাবি দিবি না। কাউকে না। আমার তিন কন্যাকে তো নয়ই। মনে থাকে যেন।
সুলায়মান চাচা চলে যাবার পরদিনই তাঁর ছোট মেয়ে এসে আমাদের ঘরের কড়া নাড়তে লাগল। আমি দরজা খুলতেই তিনি বললেন, বাবা কোথায়?
আমি ভাল মানুষের মত মুখ করে বললাম, জানিনা তো। কিছুই জান না?
জ্বি–না।
কি আশ্চর্য কথা! একটা অসুস্থ মানুষ সে যাবে কোথায়?
হয়ত বেড়াতে গেছেন এসে যাবেন। আপনি অপেক্ষা করুন।
বিছানা থেকে নামতে পারে না একটা মানুষ সে গেছে বেড়াতে? এসব কি বলছ পাগলের মত।
ভদ্রমহিলা বিরস মুখে দোতলায় উঠে গেলেন। পেছনে পেছনে উঠলেন তাঁর স্বামী। এই ভদ্রলোকের চেহারা ভালমানুষের মত। শিশু শিশু মুখে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছেন। হাতে সিগারেট। তাঁকে দেখে মনে হল খুব মজা পাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরই ধুম ধুম শব্দ হতে লাগল। বুঝলাম তালা ভাঙ্গা হচ্ছে। সন্ধ্যার মধ্যে বাকি। দুবোনও চলে এলেন। আরো কিছু লোকজন এল। বাড়ি গমগম করতে লাগল। বড় বোন তাঁর স্বামীকে নিয়ে রাত দশটার দিকে আমাদের বাড়ির কড়া নাড়তে লাগলেন। ভাইয়া দরজা খুলে দিল। আমি এবং আপা বারান্দা থেকে তাদের কথাবার্তা শুনছি।
আমার বাবা কোথায় গেছেন জানেন?
জানি না।
মিথ্যা কথা বলছেন কেন? আমাদের আরেক ভাড়াটে ইসমাইল সাহেবের স্ত্রী বললেন–তিনি দেখেছেন আপনি বাবাকে একটা সবুজ রঙের গাড়িতে করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছেন।
উনি পুরোপুরি সত্যি বলেন নি। গাড়ির রঙ ছিল নীল, নেভী ব্লু।
তাহলে যে আপনি বললেন–আপনি জানেন না বাবা কোথায়?
ঠিকই বলেছি। আমি ভোরবেলায় বেরুচ্ছি–দেখি উনি গাড়িতে। আমাকে বললেন, কোথায় যাবে রঞ্জু? আমি বললাম, সদরঘাট। চাচা বললেন, উঠে আস, আমি তোমাকে গুলিস্তানে নামিয়ে দেব। আমি উঠলাম, গুলিস্তানে নেমে গেলাম।
বাবা কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করেন নি?
জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, ভাল দেখে একটা ক্যামেরা কিনতে চান। স্টেডিয়ামের ইলেকট্রনিক্স দোকানগুলিতে ঘুরবেন।
বাবার বিছানা থেকে নামার শক্তি নেই। আর তিনি কি-না স্টেডিয়ামে ঘুরে ঘুরে ক্যামেরা কিনবেন?
আমি যা জানি আপনাকে বললাম। তাছাড়া উনি বিছানা থেকে নামতে পারেন না বলে যা বলছেন তাও সত্যি না। হেঁটে হেঁটেই তো গাড়িতে উঠলেন। ধরেও নামাতে হল না।
আমি আপনার একটি কথাও বিশ্বাস করছি না।
আপনার কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছি বললে ভুল বলা হবে। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না এটাই স্বাভাবিক।
বাবার সঙ্গে কি জিনিসপত্র ছিল?
আমার কোন কথাই তো আপনি বিশ্বাস করছেন না। শুধু শুধু প্রশ্ন করছেন কেন?
বলুন উনার সঙ্গে জিনিসপত্র কি ছিল?
বলতে চাচ্ছি না।
এবার শোনা গেল ভদ্রমহিলার স্বামীর গলা। মেয়েদের মত চিকন স্বরে তিনি বললেন, আমি অন্য প্রসঙ্গে আপনাকে একটা কথা বলছি। সব ভাড়াটেদেরই বলা হয়েছে, শুধু আপনাকে বলা বাকি। কথাটা হচ্ছে পারিবারিক প্রয়োজনে পুরো বাড়িটা আমাদের দরকার। আপনাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।
কবে নাগাদ?
এক মাসের মধ্যে ছাড়তে হবে।
সেটা তো ভাই সম্ভব হবে না। প্রথমত মুখের কথায় নোটিশ হয় না। আপনাদের লিখিতভাবে জানাতে হবে। দ্বিতীয়ত, নোটিশ আপনার পাঠালে হবে না। যার বাড়ি তাঁকে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশের পরেও তিনি মরে গিয়ে থাকলে ভিন্ন কথা–অবশ্যি তারপরও সমস্যা আছে–কোর্ট থেকে আপনাদের সাকসেসান সাটিফিকেট বের করতে হবে।