আপনার হয়েছে?
একেবারে যে অবিশ্বাস হচ্ছে তা না। জাতে অনেক অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে। দেখা যাক না সাতদিন অপেক্ষা করে। ক্ষতি তো কিছু নেই।
লোকটা পুরোপুরি বোগাস চাচা–বাবা কখনো পাঞ্জাবী পরেন না। ব্যাটা তাঁকে দেখেছে পাঞ্জাবী পরে বসে আছেন।
হয়ত শখ করে পরেছেন। দেখা যাক না। সাতটা দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
সাতদিন কাটল। অষ্টম দিনে আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে রইলাম। আমরা কেউ ব্যাপারটা বিশ্বাস করছি না তবু মনে মনে অপেক্ষা করছি। আমাদের মধ্যে সবচে যে অবিশ্বাসী–ভাইয়া–সে ভোরবেলা বাজার থেকে মাছের মাথা কিনে আনল। দুপুরে আমরা মাথা খেলাম না–অপেক্ষা করে রইলাম রাতের জন্যে। বাবা যদি রাতে আসেন। রাতেও এলেন না। আমরা যথারীতি খাওয়াদাওয়া করলাম। ভাইয়া আধুনিক ঈশপের গল্প বলে সবাইকে হাসাল। মাও হাসলেন।
রাত এগারোটা থেকে বৃষ্টি নামল। মুষলধারে বৃষ্টি। মা আমাকে ডেকে বললেন–রেনু, রঞ্জুকে বল না এক পোয়া চিনি নিয়ে আসতে।
এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে?
মা মৃদু গলায় বললেন, লোকটা যদি ভিজতে ভিজতে আসে। এসেই চা খেতে চাইবে। ঘরে একদানা চিনি নেই।
ভাইয়াকে বলতেই সে বৃষ্টি মাথায় করে চিনি আনতে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুলু আপাদের বাড়ির কাজের ছেলেটি এসে আমাকে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। সেখানে লেখা,
রেনু, খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ছাদে ভিজতে ইচ্ছা করছে। তুমি আসবে? প্লীজ।
চলে এসো। আমার মনটা ভাল না।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। মন খারাপের কত তুচ্ছ কারণ থাকে মানুষের। মুষল ধারে বৃষ্টি পড়ছে এই দেখে একজনের মন খারাপ হয়ে গেছে। সে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মন ভাল করার চেষ্টা করবে।
আমি দুলু আপার বাড়িতে গেলাম না। অনেক রাতে ঘুমুতে গিয়ে দেখি মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পরেছেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় কয়েকবার ডাকলাম–মা সাড়া দিলেন না। যদিও জানি তিনি জেগে আছেন। চলে এলাম ভাইয়ার ঘরে। সেও শোবার জোগাড় করছে।
তোমার ঘরে শোব ভাইয়া।
ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, অনুমতি দেয়া হল। কণ্ডিশান আছে।
কি কণ্ডিশান?
ভোর পাঁচটায় ডেকে দিতে হবে, পারবি?
এত ভোরে উঠার তোমার দরকার কি?
এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হয়েছে। সে আমাকে বরিশাল নিয়ে যাবে। ট্রাক ছাড়বে ভোর ছটায়।
বরিশাল যাবে কেন?
একটা কাজ আছে।
বাবার কোন খোঁজ পেয়েছ?
হুঁ।
সদরঘাটের এক লোক বলল–দিন দশেক আগে সে বাবাকে দেখেছে। বরিশাল যাবার লঞ্চে উঠছেন।
দিন দশেক আগে সে বাবাকে ঢাকায় দেখেছে?
তাই তো বলল।
বাবাকে সে চেনে?
ছবি দেখে চিনেছে। নাম জানে না। চেহারায় চেনে।
আমাদের তুমি বলনি কেন?
লোকটার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি, তাই বলি নি।
বিশ্বাস হয় নি কেন?
লোকটার চেহারা প্রফেশনাল মিথ্যাবাদীর মত।
চেহারা মিথ্যাবাদীদের মত আবার কি?
মিথ্যাবাদী লোকদের চেহারায় মিথ্যার ছাপ পড়ে।
ও শুধু শুধু মিথ্যা বলবেই বা কেন?
প্রাফেশনাল মিথ্যাবাদীরা কারণ ছাড়াই মিথ্যা বলে–তাদের একজনকে তুই যদি জিজ্ঞেস করিস, ভাই বাসাবো যাব কোন রাস্তায়? সে ভাল মানুষের মত মুখ করে বলবে–বাসে করে চলে যান। সহজ হবে।
কোন বাসে উঠব?
প্রফেশনাল মিথ্যাবাদী তখন কি করবে জানিস? ভুল একটা বাসে উঠিয়ে দেবে। এতেই এদের আনন্দ। ভাল কথা, বরিশাল যাবার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিস না। বাবাকে পাওয়া গেলে মজার একটা সারপ্রাইজ হবে। সারপ্রাইজ নষ্ট করে লাভ নেই।
ভাইয়া বরিশাল থেকে কোন খবর ছাড়াই ফিরে এল। অন্তত আমার তাই ধারণা কারণ কাউকে সে কিছু বলল না। আমিও কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। সে যদি নিজ থেকে কিছু বলতে চায় বলবে।
আমি আবার ভাইয়ার ঘরে থাকতে শুরু করেছি। কারণ মা এখন আমাকে ঠিক সহ্য করতে পারছেন না। অল্পতেই খিটমিট করেন–একি গায়ে পা তুলে দিচ্ছিস কেন? ভালমত ঘুমা। অকারণে এত নড়াচড়া করিস না তো। বিশ্রী লাগে।
শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, আমি কি ভাইয়ার ঘরে ঘুমুব?
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, যা ইচ্ছা ক বিরক্ত করিস না।
ভাইয়ার স্বভাব কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আগের হাসি খুশী ভাব খানিকটা কমে গেছে। রাতে দুটা টিউশানী করে খুব ক্লান্ত হয়ে ফিরে। ভাত খেয়েই বুকের নীচে বালিশ দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। পত্রিকার লেখা লিখতে হয়। লেখার সময় মেজাজ খুব খারাপ থাকে। কর্কশ গলায় বলে, চা দে তো রেনু।
আমি যদি বলি, চিনি ছাড়া দেব ভাইয়া? চিনি শেষ হয়ে গেছে।
ভাইয়া বিশ্রী ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠবে, চিনি নেই সেটা রাত-দুপুরে বলছিস কেন? দিনে মনে ছিল না? যেখান থেকে পারিস চিনি দিয়ে চা বানিয়ে আন।
আমি প্রায় মাঝরাতে চিনি আনতে দুলু আপাদের বাসায় গেলাম। তিনি ফ্লাস্ক ভর্তি চা বানিয়ে দিলেন। শুধু চা না, সঙ্গে এক প্লেট নোনতা বিসকিট। স্লাইস করে কাটা পনির।
ভাইয়া চা খায়, পনির মুখে দেয়। একবারও বলে না–কোখেকে জোগাড় হল। তার লেখালেখির সময়টা আমি বারান্দায় বসে থাকি। যে সব রাতে দুলু আপা গান বাজায়–আমার সময়টা ভাল কাটে। তবে বেশীরভাগ সময় বসে থাকতে হয় চুপচাপ। দুলু আপার স্বভাবেরও বোধ হয় পরিবর্তন হয়েছে। আগের মত একই গান লক্ষবার বাজান না।
শুনতে পাচ্ছি তাঁর বিয়ের কথা হচ্ছে। যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছে তাকে একবার দুলু আপাদের বাড়িতে দেখেছি। আমার পছন্দ হয় নি। মানুষটা হয়তবা খুবই ভাল। প্রথম দর্শনে কোন পুরুষকেই আমার পছন্দ হয় না। পুরুষদের বোধ হয় উল্টোটা হয়–প্রথম দর্শনে সব মেয়েকেই ভাল লাগে।
কাউকে মারা যেতে দেখেছেন
আচ্ছা আপনি কি খুব কাছ থেকে কাউকে মারা যেতে দেখেছেন?