বাবা বললেন, সাইনিং মানি ব্যাপারটা কি?
ছবি করতে রাজি হলে চুক্তিপত্রে সই হবে, তখন টাকাটা দেয়া হবে। তারপর ছবি যত এগুবে তত ভাগে ভাগে টাকা দেয়া হবে। ফিল্ম লাইনে পুরোটা এক সঙ্গে দেয়ার নিয়ম নেই।
বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, সব মিলিয়ে কত হবে?
নতুনরা খুব বেশী পায় না তবে আমরা ভালই দিব পঞ্চাশ তো বটেই।
পঞ্চাশ কি?
পঞ্চাশ হাজার।
ও আচ্ছা আচ্ছা হাজার। হাজারতো হবেই পঞ্চাশ টাকাতো দিতে পারেন না। হা-হা-হা। চা খাবেন স্যার?
জিনা চা খাব না। আপনার মেয়েকে ডাকুন তার সঙ্গেও কথা হোক। আমাদের কি কথাবার্তা হচ্ছে তার শোনা দরকার।
বাবা বললেন, ও আছে। এইখানে কি কথাবার্তা হয় সব বারান্দা থেকে শুনা যায়। একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
স্যার আপনারা আমার মেয়ের খোজ পেলেন কোথায়?
তার এক বান্ধবীর জন্মদিনে সে গিয়েছিল আমিও সেখানে ছিলাম। মনে ধরল, বেশ সুইট চেহারা। অবশ্যি হাইট কম। সেটা আমরা ক্যামেরায় ম্যানেজ করব।
অভিনয় তো জানে না।
শিখিয়ে পড়িয়ে নেব। সিনেমা হচ্ছে ডাইরেক্টরস মিডিয়া। ডাইরেক্টর ইচ্ছা করলে একটা কাঠের চেয়ারকেও নায়িকার রোল দিয়ে পার করে নিয়ে আসতে পারে?
তাই না-কি?
না মানে কথার কথা বলছি–আর কি। রূপক অর্থে বলা। ডাকুন আপনার মেয়েকে।
বাবা দুঃখিত গলায় বললেন, ওকে ডাকাডাকি করে লাভ নেই ও করবেনা। বরং আমার ছোট মেয়েটাকে দেখতে পারেন–রেনু। চটপটে আছে। ডাকবাক্স না পোস্টবক্স নামে রবি ঠাকুরের একটা নাটক আছে না? ঐটাতে অভিনয় করেছিল। ভাল হয়েছিল। আমি অবশ্যি দেখিনি–শুনেছি। নানা কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকি সময় পাই না। টুকটাক বিজনেস করি। ছোট বিজনেসম্যান হল–ফকিরের মত। শুধু হাঁটাহাঁটি। স্যার ছোট মেয়েটাকে ডাকব?
না আপনি বড় জনের সঙ্গেই কথা বলুন। সিনেমার কথা শুনলে রাজি হতেও পারে। টিন এজারদের এই দিকে খুব ঝোঁক।
বাবা উঠে এলেন। আপা বাবাকে দেখেই পাথরের মত মুখ করে বলল–না।
বাবা ইতস্ততঃ করে বললেন, ভদ্রলোক মানুষ, কষ্ট করে এসেছেন। টাকা পয়সাও নিয়ে এসেছেন। সেকেণ্ড থট দিবি নাকি?
না।
সরাসরি না বলার কি দরকার? তুই গিয়ে বল আমি ভেবে দেখব। ভদ্রলোক কষ্ট করে এসেছেন।
আপা আগের চেয়েও কঠিন স্বরে বলল, না।
বাবা নীচু গলায় বললেন, সিনেমা লাইনটা খারাপ না। ভাল ভাল মেয়েরা এখন যাচ্ছে। তা ছাড়া নিজে ভাল থাকলে জগৎ ভাল। নিজে মন্দ হলে জাৎ মন্দ। ভাল মন্দ নিজের কাছে। কি, ওদের চলে যেতে বলব?
হ্যাঁ।
ভদ্রলোকরা চলে গেলেন ঠিকই তারপরেও দুবার এলেন। শেষবার এলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে। সব একশ টাকার নোট। বসার ঘরের বেতের টেবিলটা ঢাকায় প্রায় ভরে গেল। আমি আমার আঠারো বছরের জীবনে এত ঢাকা এক সঙ্গে দেখিনি। ভাইয়া বলল একশ টাকার নোটে পঞ্চাশ হাজার টাকার ওজন কত জানিস? মাত্র এক পোয়া।
আমি বললাম, কেমন করে জানলে, তুমি ওজন করেছ?
করেছি। একশটা একশ টাকার নোট ওজন করে সেখান থেকে বের করেছি। সহজ ঐকিক নিয়ম।
ভাইয়ার এইসব কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে মিথ্যা কথা সত্যের মৃত করে বলে। সত্য কথাগুলি মিথ্যার মত বলে। আমরা সবাই তাতে খুব মজা পাই। বাবা হাসি মুখে বলেন, ফানি ম্যান, ভেরী ফানি ম্যান। শুধু আপা রাগ করে।
ভাইয়ার উপর আপার রাগ আরো বাড়ল যখন ভাইয়া তাকে ম্যাডাম ডাকা শুরু করল। সিনেমাতে নায়িকাঁদের নাকি ম্যাডাম ডাকার নিয়ম। ভাইয়া ম্যাডাম ডাকছে আর আপা রাছে। রাগলে আপার ফর্সা মুখ লাল টকটকে হয়ে যায়। নাক ঘামতে থাকে। চোখের মনি হয়ে যায় স্থির। তখন আমি আপার দিকে তাকিয়ে ভাবি–ইস আমি কেন এত সুন্দর হলাম না। যদিও অভিনয় করার জন্যে আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হত না। বিনা টাকাতেই আমি অভিনয় করে দিয়ে আসতাম ইস আরেকটু যদি সুন্দর হতাম। দরিদ্র পরিবারে সুন্দরী হয়ে জন্মানো খুব সুখের নয়। আমি খুব ভাল করে জানি।
যেই দেখছে সেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। পিওন এক গাদা চিঠি রোজ দিয়ে যাচ্ছে। যার বেশীর ভাগই রেজিস্ট্রি। সেই সব চিঠির সবই প্রেমপত্র। খুব কাচা হাতে লেখা। ভুল বানান। লাইনে লাইনে কবিতা–। কিছু কিছু চিঠির কথাবার্তা অসম্ভব নোংরা। সেসব চিঠি হাত দিয়ে ছুলেও হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আপা কোনদিনও একটি চিঠি পড়ে দেখেনি। মানুষের সাধারণ কৌতুহলওতো থাকে–কি লিখছে, জানার আগ্রহ। আপার নেই। সেইসব চিঠি পড়তাম আমরা দুজন। আমি এবং ভাইয়া। চিঠিতে নাম্বার দেওয়া হত। কোনটা পাচ্ছে একশতে দশ, কোনটা একশতে পাঁচ। এর মধ্যে একটা চিঠি এল ইংরেজীতে। সম্বোধন হচ্ছে–
My dearest Moonshine
ভাইয়া পনেরে৷ টাকা খরচ করে সেই চিঠি বাঁধিয়ে এনে আপীর জন্মদিনে আপাকে প্রেজেন্ট করল। আপা খানিকক্ষণ ঠাণ্ডা চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি যদি আর কোনদিন আমার সঙ্গে এ রকম রসিকতা কর তাহলে আমি কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
কোথায় যাবি?
আমার যাবার জায়গার অভাব নেই–তুমি এটা ভালই জান। ঐ সিনেমা। ওয়ালাদের কাছেও যেতে পারি। ওরা কার্ড দিয়ে গেছে।
সরি, আর করব না।
আপা খাবার টেবিল থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। জন্মদিন দিন তো আমাদের পরিবারে হয় না। হবার কথাও না। সেদিন মজা করবার জন্যেই ভাইয়া একটা কেক কিনে এনেছিল। কেকের উপরে লেখা–