ভাইয়া বলল, চাচা আপনার নিজের মেয়ে। এসব কি বলছেন?
সুলায়মান চাচা বললেন, এরা এখন আর মেয়ে না–এরা স্বামীর হাতের রোবট। স্বামীরা বোতাম টিপে এদের কন্ট্রোল করছে। হাসতে বললে হাসে, কাঁদতে বললে কাঁদে। এখন ওরা হা করে বসে আছে–কখন মরব। রোজ খোজ নিতে আসে অবস্থা কি? আর কত দেরী।
ভাইয়া বলল, উনারা ভাল মনেই আসেন।
মোটেই ভাল মনে আসে না। আমি মুখ দেখেই বুঝতে পারি। ওরা যখন দেখে আমার শরীর একটু ভাল তখন মুখ লম্বা করে ফেলে। সে একটা দেখার মত দৃশ্য। তবে ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে–এমন পাঁচ দেব–বুঝবে ঠ্যালা।
কি ঠ্যালা?
মেজো মেয়েকে সব জমিজমা দানপত্র করে যাব। ঐ মেয়েটাই সবচে বদ। তখন খেলা জমে যাবে। বাকি দুইজন তাকে ছিড়ে ফেলবে। সম্পত্তি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হবে। তিন জামাই যে থ্রী কমরেডস হয়েছে কমরেডশীপ বের হয়ে যাবে। শুরু হবে সাপে নেউলে–হা হা হা।
প্ল্যান খারাপ না চাচা।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্ল্যান বের করা। প্ল্যান খারাপ হবে কেন? তোর বাবার সন্ধান বের করার জন্যেও প্ল্যান করছি। সারাদিন তো বাসায় শুয়েই থাকি। শুয়ে শুয়ে ভাবি।
পেয়েছেন কিছু?
এখনো কংক্রিট কিছু পাই নি। তবে সব রকম চেষ্টা চালাতে হবে। ভৌতিক, আধিভৌতিক। দরকার হলে জ্বীনের সাহায্য নিতে হবে। ছোটবেলায় দেখেছি কেউ হারিয়ে গেলে জ্বীন নামানো হত।
আমি হেসে ফেললাম। সুলায়মান চাচা বিরক্ত গলায় বললেন, এই মেয়ে হাসে কেন? জগতে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার হয়। বুঝলি মেয়ে–সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিতে নাই। জ্বীন, পরী সবই আছে।…
আমি বললাম, একবার জ্বীন নিয়ে আসুন চাচা। আমার জ্বীন দেখার খুব শখ।
দেখি পাওয়া যায় কি-না। এই লাইনে ওস্তাদ লোকজন পাওয়াই মুশকিল। চর্চা নাই। দু একজনকে বলেছি–ওরা চেষ্টা চরিত্র করছে।
আমরা উঠে আসার আগে সুলায়মান চাচা নীচু গলায় বললেন, রঞ্জু, শোন, টাকা পয়সা লাগবে?
ভাইয়া বলল, না।
চালাচ্ছ কিভাবে?
চালাচ্ছি না। চাকা আপনা আপনি ঘুরছে।
করছ কিছু?
বাংলা বাজারে বইয়ের প্রুফ দেখছি। নতুন একটা পত্রিকা বের হয়েছে তার সঙ্গেও আছি। দু হাজার করে দিবে বলছে–দেখি।
চাকরি বাকরির চেষ্টা কিছু করছ না?
না।
না–কেন?
কোন লাভ নেই খামাখা পরিশ্রম।
ব্যারিস্টার সাহেবকে বলে দেখলে হয় না? উনার সঙ্গে তো তোমার খুব খাতির। খাতির আছে না এখনো?
আছে।
তাহলে বল উনাকে।
বলব, আগে মন্ত্রী হোক। শোনা যাচ্ছে মন্ত্রী হতে বেশী দেরী নেই। মন্ত্রী হলে ধরব। উনার মন্ত্রী হবার জন্য আমি দিনরাত দোয়া করছি। ভাবছি একটা খতম পড়াব। খতমে ইউনুস।
এক সন্ধ্যায় সুলায়মান চাচা খবর পাঠিয়ে আমাকে এবং ভাইয়াকে নিয়ে গেলেন। তাঁর ঘরে রোগী লম্বা এক লোক বসে আছে। ছোট ছেটি চোখ, গায়ে কটকটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবী। সুলায়মান চাচা গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন, উনাকে খবর দিয়ে এনেছি। উনি হচ্ছেন একজন গণক। নিখোজ লোকের সন্ধান দিতে পারেন। খুব নাম ডাক আছে।
ডুবন্ত মানুষ খড়কুটা আঁকড়ে ধরে। হলুদ পাঞ্জাবী গাঁয়ে এই লোককে খড়কুটারও অধম লাগছে। একে আকড়ে ধরার কোন মানে হয় না।
ভাইয়া বলল, জনাব আপনার নাম?
এমন ভঙ্গিতে জনাব বলল যেন সে নাটোরের মহারাজাকে সম্বোধন করছে। ঐ লোকও খানিকটা ঘাবড়ে গেল। নীচু গলায় বলল, আমার নাম আবদুর রহমান।
আবদুর রহমান সাহেব, নিখোঁজ লোক খুঁজে বের করাই কি আপনার একমাত্র পেশা না অন্য কিছুও করেন?
সাইড ব্যবসা আছে।
মূল ব্যবসা লোক খোজা? কিভাবে খুঁজেন–মন্ত্র আছে?
মন্ত্র না। আল্লাহ পাকের পাক কালাম।
কত টাকা নেন এর জন্যে?
কনট্রাক্টে কাজ করি। কাজ সমাধ্য হইলে টেকা নেই। লোক বুঝে নেই। পঞ্চাশ টাকাও নেই আবার ধরেন, দশ হাজারও নেই।
দশ হাজার কেউ দিয়েছে?
জ্বি দিয়েছে। এক ব্যবসায়ীর ক্লাস টুতে পড়ে ছেলে হারায়ে গিয়েছিল–গণে বের করলাম।
বলেন কি?
কথা বিশ্বাস না করলে সাটিফিকেট দেখেন।
মারহাবা আপনার সার্টিফিকেটও আছে?
সুলায়মান চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, খামাখা এত কথা বলছ কেন রঞ্জু? ও বলছে কনট্রাক্টে কাজ করবে তাই করুক। যদি সন্ধান দিতে পারে আমরা তাকে পাঁচশ টাকা দেব।
ভাইয়া উদাস গলায় বলল, ঠিক আছে দেব।
ভদ্রলোককে বাবার নাম, দাদার নাম দেয়া হল। বাবার ব্যবহারী একটা সার্ট দেয়া হল। সেই সার্ট মাথায় জড়িয়ে সে চোখ বন্ধ অবস্থায় গুন গুন করে খানিকক্ষণ কি যেন পড়ল। চোখ খুলে খুবই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, উনি রওনা হয়ে গেছেন। এখন আছেন মোটরে। চলন্ত অবস্থায় তাঁকে দেখলাম। শরীর ভাল আছে। তবে একটু কফ হয়েছে।
ঢাকায় পৌঁছবেন কবে?
এক সপ্তাহ লাগবে?
মোটরে আসতে এক সপ্তাহ লাগবে? বলেন কি? উনি আছেন কোথায়, দিল্লীতে?
তা বলতে পারতেছি না–তবে ঠিক এক সপ্তাহ লাগবে আসতে।
উনার গায়ে কি কাপড় দেখলেন?
পাঞ্জাবী।
শাদা রঙের না খদ্দর?
শাদা।
আচ্ছা ভাই আরেকজনের সন্ধান দিতে পারেন কি-না দেখেন। এর নাম আভা। এ ঢাকা শহরেই আছে। কোথায় আছে জানি না।
আবদুর রহমান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, একদিনে দুইজনের কাজ করতে পারি না। এখন যাতায়াত খরচ দেন, চলে যাই। সাতদিন পরে এসে পাঁচশ টাকা নিয়ে যাব।
ভদ্রলোককে কুড়ি টাকা যাতায়াত ভাড়া দেয়া হল। সুলায়মান চাচাই দিলেন।
ভাইয়া বলল, এই মক্কেল কোত্থেকে জোগাড় করেছেন চাচা?
তোমার বিশ্বাস হয় নি, না?