ভাইয়া যা শিখে আসছে আমিও সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে সব শিখে নিচ্ছি। খাবার টেবিলে দুজন গম্ভীর ভদিতে জাপানীতে কথা বলি। অথচ আড়াই মাস হয়ে গেল–বাবার খোঁজ নেই, তিনি কোথায় আছেন কিছুই জানি না। দুপুরবেলা আমরা সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি–কারণ ঠিক দুপুরে পিয়ন আসে। পিওন আসে এবং চলে যায়। চিঠি আসে না। আমাদের উৎকণ্ঠা কাটে না। হয়ত টেলিগ্রাম আসবে। টেলিগ্রাম পিয়ন তো যে কোন সময় আসতে পারে।
আমরা সবাই যে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা এবং অনিশ্চতায় বাস করছি তা একজন অজনকে বুঝতে দেই না। সংসার একেবারে অচল অবস্থায় এসে ঠেকেছে। ঠিক ঝি নেই। ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম মা এবং আপা করছেন। আপাই বেশী করছে। মার শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। তিনি তেমন কিছু করতে পারেন না। বেশীরভাগ সময় বারান্দায় বসে থাকেন।
সংসার এখনো কি করে চলছে আমি জানি না। দুবেলা রান্না হচ্ছে তা দেখছি। দুঃসময়ের জন্যে মার নানা রকম গোপন সঞ্চয় আছে। একে একে সেইসব সঞ্চয় ব্যবহৃত হচ্ছে। তাও নিশ্চয়ই শেষের দিকে। গত সপ্তাহে প্রথমবারের মত কলেজে যাবার আগে আগে বললেন, বাদ দে, কলেজে যেতে হবে না।
আমি বললাম, কেন যেতে হবে না মা?
মা চুপ করে রইলেন।
রিকশা ভাড়া দিতে পারবে না–তাই না?
হুঁ।
হেঁটে যাব। তোমাকে রিকশা ভাড়া দিতে হবে না।
বাসা থেকে বই খাতা নিয়ে আমি বের হই–বেশীরভাগ দিনই কলেজে যাই। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি। কেন হুঁটি বলুন তো? হ্যা, ঠিক ধরেছেন আমি বাবাকে খুঁজি। প্রতিদিনই মনে হয় আজ হয়ত পাব। হঠাৎ দেখব রাস্তার মোড়ে কোন চায়ের দোকানে বসে বাবা চা খাচ্ছেন–হাতে খবরের কাগজ। বাবাকে দেখে প্রচণ্ড চিৎকার দিতে গিয়েও আমি দিলাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে চুপিচুপি তাঁর পেছনে দাঁড়ালাম। কানের কাছে মুখ নিয়ে নীচু গলায় গানের মত সুরে বললাম, বাবা!
তিনি চমকে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন, আরে খুকি, তুই এখানে কোত্থেকে?
আমি বললাম, আগে বল তুমি এখানে কি করছ?
চা খাচ্ছি।
আমরা চিন্তায় মরে যাচ্ছি, আর তুমি আরাম করে চা খাচ্ছ?
চিন্তায় মরে যাচ্ছিস কেন?
আনাতা মো ইশশোনি ইকিমাসেন কা!
ইকড়ি মিকিড়ি করছিস কেন?
ইকড়ি মিকিড়ি না এটা হচ্ছে জাপানী ভাষা।
জাপানী বলছিস কেন?
বাসার সিষ্টেম বদলে গেছে বাবা। বাসায় কথাবার্তা সব হয় জাপানীতে।
বলিস কি?
তোমাকেও জাপানী শিখতে হবে নয়ত কথাবার্তা বলতে পারবে না।
এতো আরেক যন্ত্রণা হল দেখি।
বাবার সঙ্গে দেখা হলে প্রথম কথা কি বলব তা ভেবে ভেবে পথ হাঁটতে ভাল লাগে। বাসায় ফিরি ক্লান্ত হয়ে কিন্তু এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে। মনে হয় বাসায় পা দিয়েই দেখব–বাবা এসেছেন। চুলে কলপ দিয়ে যুবক সাজার হাস্যকর প্রচেষ্টা যথারীতি করেছেন। দাঁতও ওয়াশ করা হয়েছে। মার জন্যে অতি বদরঙা শাড়িও আনা হয়েছে। বারান্দার মোড়ায় বসে পা দোলাতে দোলাতে চা খাচ্ছেন। কাছেই বাজারের ব্যাগ। চা শেষ করে চলে যাবেন মাছের মাথা কিনতে। সবচে পচা মাথাটা কিনে হাসি মুখে ফিরবেন। রান্নার সময় মার পাশে বসে ডিরেকশন দেবেন–দুটা কাঁচা মরিচ ছেড়ে দাওতো। আর এক চিমটি পাঁচ ফোড়ন।
তিনমাস পার হবার পর আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম। ছবিসহ বিজ্ঞাপন। ভাইয়া থানায় গিয়ে জিডি এন্ট্রি করাল। ওসি সাহেব বললেন, উনার কি কোন শত্রু আছে?
ভাইয়া দুঃখিত গলায় বলল, শত্রু থাকবে কেন?
ওসি সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মহাপুরুষদেরও তো শত্রু থাকে ভাই। গান্ধিজীকেও আততায়ীর হাতে মরতে হয়েছিল।
মৃত্যুর কথা বলছেন কেন?
কথার কথা বলছি। তবু পসিবিলিটি কিছু থাকেই। আপনি বলছেন ব্যবসায়ের কারণে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়–ধরুন কোন হোটেলে হার্ট এ্যাটাক হল। কেউ জানে না এই লোক কে? তখন একদিন অপেক্ষা করে সাধারণত মাটি দিয়ে দেয়।
বলেন কি?
আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মানুষ কখনো পকেটে ঠিকানা নিয়ে ঘুরে না। আপনি দিন সাতেক পরে আসুন। এ জাতীয় কেইস থানায় রিপোর্টেড হয়। খবর বের করে রাখব। ঘাবড়াবেন না।
ঘাবড়াচ্ছি না।
শুধু ভাইয়া না, আমরা কেউ ঘাবড়াচ্ছি না। অন্তত আমাদের দেখে কেউ বলবে না আমরা ভেঙ্গে পড়েছি। শুধু একটু বেশী হাসাহাসি করছি। আগের চেয়ে শব্দ করে কথা বলছি। রাত একটা দুটা পর্যন্ত জেগে বসে থাকছি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলে এক সঙ্গে দু তিন জন ছুটে যাচ্ছি।
আমার ধারণা ছিল, পত্রিকায় ছবি বের হবার পর অনেকেই আমাদের বাসায় আসবে। বাবার বন্ধুরা যারা তাঁর সঙ্গে ব্যবসা করেন। যাদের সঙ্গে কর্মসূত্রে তাঁর ঘনিষ্ঠত হয়েছে। আশ্চর্য! কেউ এল না। তাহলে ব্যাপার কি এই দাঁড়াচ্ছে যে তাঁর কোন বন্ধু বান্ধব ছিল না? মিত্রহীন একজন মানুষ এই শহরে দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়েছে?
সুলায়মান চাচা একদিন বললেন, রেনু তোর বাবার একটা ছবি আমাকে দিস তো?
ছবি দিয়ে কি হবে চাচা?।
চকবাজারে যাব। ছোট ব্যবসায়ীরা সবাই কোন না কোনভাবে চকবাজারের সঙ্গে যুক্ত। ওদের ছবি দেখালে চিনতে পারে।
আমাকে সঙ্গে নেবেন চাচা?
আচ্ছা নেব। শরীরটা একটু ঠিক হোক তারপরই …।
সুলায়মান চাচার শরীর খুবই খারাপ করেছে। বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যাওয়াও নিষিদ্ধ। সেবার জন্যে তাঁর তিন মেয়েই এসেছিল। তাদের তিনি হাঁকিয়ে দিয়েছেন। ভাইয়াকে বলেছেন, এরা স্বামীর পরামর্শে আমাকে খুন করবে। মুখে বালিশ চেপে ধরবে। তিনজন এক সঙ্গে বালিশ চেপে ধরলে আর দেখতে হবে না।