বলেছিল করবে। তোমাকে দিয়ে দুলুর কাছ থেকে আনবে। এই দেখ, তোমাদের সব কথা আমি জানি। রেনু, আমাকে রিকশা ভাড়া দাও। আমি চলে যাই। আর শোন, এই কাজে আমার বাসার ঠিকানা লিখে দিলাম–রঞ্জকে দেবে।
ভাইয়া তো আপনার বাসা চেনে।
এই বাসাটা চেনে না। আমরা বেশী দিন এক বাসায় থাকি না। ভাড়া জামে যায়, তারপর বাসা বদলাই।
আভা হেসে ফেলল যেন খুব মজার কোন কথা।
আমার কাছে একটা দশ টাকার নোট ছিল। আগামীকাল কলেজে যাবার ভাড়া। নোটটা এনে দিলাম।
আভা বলল, রেনু যাই। রঞ্জুকে কাগজটা দিও।
দুঃখের ব্যাপার কি জানেন? ভাইয়াকে আমি কাগজটা দিতে পারলাম না। টেবিলের উপর বই-চাপা দিয়ে রেখেছিলাম–ভাইয়া বাসায় ফিরলে কাগজটা পেলাম না। পুরো টেবিল দু তিনবার খোঁজা হল। কাগজ পাওয়া গেল না। ভাইয়া বলল, বাদ দে। আভাই আসবে। আমার সমস্যা আছে। আমি ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারি না। ঠিকানা থাকা না থাকা আমার কাছে একই।
এত জ্বর নিয়ে গেল তুমি তাকে দেখতে যাবে না?
ঠিকানা নাই, যাব কি করে? টাকাটা খামে ভরে তোর কাছে দিয়ে দিচ্ছি। এর পর যখন আভা আসবে তাকে দিয়ে দিবি। ও কালই আসবে।
উনি কাল আসবেন না। তুমি যদি না যাও উনি আসবেন না।
কে বলল তোকে?
আমি জানি।
তোদের বয়েসী মেয়েদের সবচে বড় সমস্যা কি জানিস? তোদের বয়েসী মেয়েরা মনে করে তারা পৃথিবীর সব কিছুই জানে। আসলে কিছুই জানে না। আভা কালই আসবে। দশ টাকা বাজি।
আভা এল না। এক মাস পার হয়ে গেল–তারপরেও না। ভাইয়া পুরানো বাড়িওয়ালার কাছে খোঁজ নিতে গিয়েছিল। সে রেগে ভূত হয়ে আছে। ভাইয়াকে এই মারেতো সেই মারে অবস্থা।
এই মেয়ে কি আপনার আত্মীয়? স্ট্রেট জবাব দেন। ভয়ংকর মেয়ে–রাত আটটার সময় আমাকে বলল, চাচা কাল দুপুরে বারটার মধ্যে চারমাসের ভাড়া দিয়ে দেব। খুব লজ্জিত, এত দেরী করলাম। বেশ কিছু টাকা পেয়েছি। চেক। ব্যাংকে জমা দিয়েছি। কাল ক্যাশ হবে। প্রথম টাকাটা তুলেই আপনাকে দেব।
আমি বললাম, ভাল কথা। তারপর মেয়েকে চা-টা খাওয়ালাম। সে হাসি মুখে খাওয়া-দাওয়া করল। আমার ছেলে ভিডিও ক্লাব থেকে উত্তম-সুচিত্রার পুরানো বাংলা ছবি এনেছে। মেয়ে বলল, ছবিটা এখন দিও না। একটু পরে দাও। আমিও দেখব।
আমার ছেলে বলল, আচ্ছা। তারপর মেয়ে করল কি সবাইকে নিয়ে বেবী টেক্সি করে বিদায়। ঘরবাড়ি খা খা করছে। বিছানা বালিশ সব আগেই সরিয়েছে। একটা একটা করে সরিয়েছে। কিছু টের পাই নাই।
অনেক মেয়ে দেখেছি জীবনে। এমন মেয়ে কিন্তু দেখি নাই। এখন আপনি বলেন–তার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কি।
কোন সম্পর্ক নেই।
সম্পর্ক নেই বললে তো হবে না। আপনি জোয়ান ছেলে আর সেও সুন্দরী মেয়ে। সম্পর্ক আছেই–তবে সাবধান করে দিচ্ছি। চার নম্বর দূরবর্তী বিপদ সংকেত। যত দূরে থাকবেন–তত ভাল থাকবেন। বৃদ্ধ মানুষের এই উপদেশ মনে রাখবেন।
দেড়মাস পার হল বাবা ফিরলেন না
দেড়মাস পার হল বাবা ফিরলেন না। এর আগে কখনো এতদিন বাইরে থাকেন নি। পনেরো দিন আগে মনি অর্ডারে তের শ টাকা পাঠিয়েছেন। কুপনে গুড়ি গুড়ি অক্ষরে লেখা–
পর সমাচার, আমি ভাল আছি। দেশের সামগ্রিক অবস্থা খারাপ। কাজেই ব্যবসা বাণিজ্যও খারাপ। কি কৰিব বুঝিতে পারিতেছিনা। জ্বর জ্ঞারিতে কিঞ্চিৎ কাবু হইয়াছি। তবে বর্তমানে সুস্থ। খাওয়া দাওয়া নিয়মিত করিতেছি। শিগগীরই আসিতেছি।
কুপনের লেখা দেখে আমরা খুব চিন্তিত বোধ করলাম। কারণ কুপনের লেখাটা বাবার হাতের না। অন্য কেউ লিখে দিয়েছে। এরকম কখনো হয় না। মা বললেন, কে লিখে দিল রে।
ভাহয়া বলল–অশনি সংকেত।
মা বললেন, অশনি সংকেত কি?
মেয়ে ছেলের হাতের লেখা বলে মনে হচ্ছে।
ভাইয়ার এই রসিকতা মাঠে মারা গেল। মা খানিকক্ষণ কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে–দ্রুত চলে গেলেন।
ভাইয়া হো হো করে খানিকক্ষণ হাসল। আমরা কেউ ভাইয়ার হাসিতে যোগ দিতে পারলাম না। আপা বিরক্ত হয়ে ধমক দিল–চুপ কর তো ভাইয়া।
রাতে মার সঙ্গে ঘুমুচ্ছি। মা বললেন, মানি অর্ডারের লেখাটা কি মেয়ের হাতের?
আমি বললাম, মেয়ের হাতের লেখা আবার কি? মেয়েদের কি কোন আলাদা লেখা হয়? ছেলেরা যেমন লেখে মেয়েরাও তেমনই লেখে। মা শুকনো ভাবে বললেন, ও।
তুমি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভাব না-কি মা?
না ভাবি না।
বাবা কয়েক দিনের মধ্যেই চলে আসবেন। তোমার মন থেকে তখন সব দুঃশ্চিন্তা দূর হবে। বাবাকে আটকে রেখ। তাকে আর বাইরে বেরুতে দিও না।
ও বেশীদিন ঘরে থাকতে পারে না।
এইবার কঠিন শাসনে বেঁধে রাখবে। দরকার হলে তালা বন্ধ করে রাখবে। পরিবে না?
মা চুপ করে রইলেন।
আমি মার গায়ে হাত রেখে বললাম, আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর বাবা ফিরে আসবে মা। আটচল্লিশ ঘণ্টা।
মা শুকনো গলায় বললেন, ফিরে এলে তো ভালই।
বাবা ফিরে এলেন না। আরো পনেরো দিন কেটে গেল। মার দিকে তাকিয়ে আমরা এমন ভাব করতে লাগলাম যেন এটা কিছুই না। বাবার দীর্ঘদিন না ফেরাটা যেন খুব স্বাভাবিক।
লেখকরা না-কি অনেক কিছু বুঝতে পারেন?
আপনি কি পারেন? আপনি কি আমাকে দেখে বলতে পারবেন আমি সুখে আছি না কষ্টে আছি? আমার কিন্তু মনে হয় না। এখন যদি আমি আপনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই আপনি ভাববেন–বাহ সুখী পরিবার তো! হাসাহাসি গল্পগুজব হচ্ছে। কে বলবে আমাদের কোন সমস্যা আছে? ভাইয়া এক জাপানী শেখার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। নিয়মিত ক্লাস করছে। জাপানী ভাষা যা শিখে আসছে–আমাদেরও শেখাচ্ছে। যেমন অজি গরম : কিয়োও ওয়া আৎসূই দেসু। গতকালও গরম ছিল : কিনেও মো আৎসুকওয়া দেসু। অনেক দিন পর আপনাকে দেখতে পাচ্ছি : ইয়াআ শিবারা।