পাগল হইনি তোকে বলল কে? গভীর রাতে তোরা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়িস তখন হা-হা করে আমি পাগলের মত হাসি।
আমি বললাম, পাগলরা হা হা করে হাসে না।
ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, দ্যাটস কারেক্ট। পাগলরা আসলেই হা হা করে হাসে না। অথচ আমরা কথায় কথায় বলি, পাগলের মত হা হা করে হাসছে। ওরা চিক্কার করে কাঁদেও না। আমার ধারণা কি জানিস যে মানুষ যত সুস্থ সে তত শব্দ করে হাসে, এবং কাঁদে।
আমি বললাম, অন্য কোন আলাপ কর তো ভাইয়া। এই প্রসঙ্গ আমার ভাল লাগছে না। প্রসঙ্গ পাল্টও।
পাল্টাচ্ছি। তুই কি তোর দুলুনী আপার কাছে থেকে আমাকে তিনশ টাকা এনে দিতে পারবি?
পারব।
আমার কথা বলবি না।
তোমার কথা বললে অসুবিধা কি?
অসুবিধা আছে। তুই বলবি তোর নিজের দরকার।
আমি টাকা আনতে গেলাম। কার দরকার কিছুই বলতে হল না। দুলু আপা। ড্রয়ার থেকে টাকা বের করতে করতে বললেন, রেনু তোদের কি খুব অসুবিধা যাচ্ছে?
আমি বললাম, । তবে সাময়িক। বাবার একটা বড় বিল আটকে আছে। কয়েকদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে।
ও আচ্ছা।
ভাইয়া যদি একটু সংসারী হত তাহলে কোন সমস্যাই হত না। সে একবার বিদেশী কোম্পানীর চাকরির অফার পেয়েছিল। বেতন শুনে তুমি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
কত বেতন?
কুড়ি। টুয়েন্টি থাউজেন্ড।
বলিস কি?
ভাইয়া রাজি হল না। বলে দূর দূর–।
দূর দূর বলল কেন?
জাহাজের চাকরি তো। জাহাজে জাহাজে থাকতে হয়। ভাইয়ার পছন্দ না।
দুলু আপা মৃদু স্বরে বললেন, জাহাজের চাকরি তো খুব ইন্টারেস্টিং হওয়ার কথা। সব সময় পানির উপর থাকা। চাকরিটা নিলেই পারত।
আমরা অনেক বুঝিয়েছি। ভাইয়া রাজি হয়নি।
কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আমার অস্বস্তি লাগছে। যা বলছি সবই মিথ্যা। কে ভাইয়াকে কুড়ি হাজার টাকার চাকরি দেবে? টাকা তো এত সস্তা এখনো হয় নি।
মিথ্যা কথা বলার আমার এই বিশ্রী স্বভাবটার কথা কি আপনাকে বলেছি? বলেছি বোধ হয়। মিথ্যা বলতে আমার খুব যে ভাল লাগে তা না তবু হঠাৎ হঠাৎ বলতে হয়। দুলু আপার সঙ্গে যখন মিথ্যা বলি তখন সত্যি খুব খারাপ লাগে।
এই যেমন এখন লাগছে। ইচ্ছা করছে তার হাত ধরে বলি–আপা যা বলেছি সব কিছু মিথ্যা। কিছু মনে করো না।
দুলু আপা বলল, বাদামের সরবত খাবি?
বাদামের আবার সরবত হয় নাকি?
হয়। পেস্তা বাদাম হামা দিস্তায় পিষে সরবত বানায়।
সেই সব সরবত তো পালোয়ানরা খায় বলে জানি।
খেয়ে দেখ, খেতে খুব ভাল।
না আপা সরবত খাব না। এখন যাব।
দুলু আপা অন্যমনস্ক গলায় বলল, আচ্ছা শোন, তোর ভাইয়া মাঝে মাঝে গভীর রাতে এমন হা হা করে হাসে কেন?
জানি না কেন? মনে হয় পাগল হওয়ার চেষ্টা করছে।
দুলু আপা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত স্বরে বললেন, পাগল হবার চেষ্টা করছে মানে?
ঠাট্টা করছি আপা।
না, তুই ঠাট্টা করছিস না–ব্যাপারটা কি বল তো?
ব্যাপার কিছু না। ভাইয়া পাগলদের উপর গবেষণা করছে তো। কাজেই মাঝে মাঝে পাগলের মত আচরণ করে। হা হা করে হাসে। তবে আপা হা হা করে হাসি কিন্তু পাগলের লক্ষণ না। পাগলেরা হা হা করে হাসতে পারে না।
কে বলল?
ভাইয়া বলেছে।
দুলু আপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন–ঐ দিন তোর ভাইয়াকে রাস্তায় দেখলাম। সঙ্গে রোগামত একটি মেয়ে। দুজন খুব হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে। ঐ মেয়েটা কে?
খুব সম্ভব আভা। সেও একজন পাগল বিশেষজ্ঞ। ওরা দুজন মিলে পাগল খুঁজে বেড়ায়।
কি যে কথা তুই বলিস না রেনু। তুই কি সব সময় এমন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলিস?
আমি কিছু বললাম না। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলাম। এমন হাসি যার অনেক রকম অর্থ হতে পারে। দুলু আপা বললেন, তোরা তিন ভাইবোন সম্পূর্ণ তিন রকম। কারোর সঙ্গে কারোর মিল নেই।
উঠি আপা?
না না বোস। আরেকটু বোস। পা উঠিয়ে আরাম করে বোস। তুই এসেই শুধু যাই যাই করিস কেন?
আচ্ছা ঠিক আছে। আজ আর যাব না। থাকব তোমার এখানে। রাতে ঘুমাব।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
তাহলে আয় ছাদে পাটি পেতে সারারাত কাটিয়ে দি। বৃষ্টির মধ্যে পাটি পেতে শুয়ে দেখেছিস? দারুন ইন্টারেস্টিং। শুদু বাতাস যখন বয় তখন খুব ঠাণ্ডা লাগে।
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি কিন্তু আপা একজন গ শ্রেণীর পাগল।
গ শ্রেণীর পাগল মানে?
তিন ক্যাটাগরীর পাগল আছে। ক, খ ও গ। তুমি গ ক্যাটাগরী।
কি সব উদ্ভট তোর কথাবার্তা। অন্য গল্প কর।
অন্য কি গল্প?
ঐ মেয়েটির কথা বল।
কোন মেয়েটির কথা?
আভা।
আভার কথা কি বলব?
যা জানিস সব বলবি।
আমি কিছুই জানি না। ঐ মেয়েটিকে কখনো দেখিনি।
সে কি?
সত্যি দেখিনি। এ বাড়িতে কখনো আসে নি।
দুলু আপা আগ্রহ নিয়ে বললেন, এলে তুই কি আমকে খবর দিবি?
হুঁ দেব।
অনেষ্ট।
অনেষ্ট।
আভার সঙ্গে দেখা হল পরদিন। দুপুর বেলা দরজা খট খট করছে। আমি দরজা খুলতেই রোগমত মেয়েটি বলল, রেনু ভাল আছ? শুরুতেই মেয়েটা আমাকে খানিকটা হকচকিয়ে দিল। হয়ত ইচ্ছা করেই দিল। মানুষকে হকচকিয়ে দিতে সবাই পছন্দ করে। আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম, আমি ভাল আছি।
তুমি কি আমাকে চেন?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, না। যদিও আমি তাঁকে খুব ভাল করেই চিনেছি। রোদে ঘুরে মুখ লাল টকটকে হয়ে আছে। মাথার চুল উড়ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব তৃষ্ণার্ত। তৃষ্ণার্ত মানুষের ঠোঁট শুকিয়ে থাকে।
রঞ্জু কি ঘরে আছে?
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়ে ভাইয়ার চেয়ে খুব কম করে হলেও চার পাঁচ বছরের ছোট। অথচ কত অবলীলায় বলছে, রঞ্জু কি ঘরে আছে?