দুলু মেয়েটাকে কি ও পছন্দ করে?
করে নিশ্চয়ই, তবে খুব করে বলে মনে হয় না।
মা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আর পছন্দ করলেই বা কি। ওরা তো আর বঞ্জুর সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেবে না। ওরা কোথায় আর আমরা কোথায়। আচ্ছা রেনু, দুলুর বাবা মন্ত্রী হচ্ছে এটা কি সত্যি?
জানি না তো। কে বলল তোমাকে?
শুনলাম।
হতেও পারে। খুব টাকা-পয়সাওয়ালা মানুষজনই তো মন্ত্রী হয়। উনার তো টাকা পয়সার অভাব নেই।
মন্ত্রী হলে ভাল হয়।
ভাল হবে কেন?
উনাকে ধরলে হয়ত তখন রঞ্জুর চাকরির একটা ব্যবস্থা হবে। আমরা প্রতিবেশী, আমাদের একটা কথা কি আর উনি ফেলবেন?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, মন্ত্রীর কারো কথাই ফেলেন না মা। তাদের বিশাল একটা কালো বাক্স আছে–সবার কথাবার্তা তাঁরা ঐ বাক্সে রেখে তালা দিয়ে দেন। ঐ তালা আর খুলেন না।
মা হাসতে হাসতে বললেন, তুইও দেখি রঞ্জুর মত হয়ে যাচ্ছিস। মজা করে কথা বলিস। আচ্ছা শোন, রঞ্জু ঐ দিন আভা নামের কি একটা মেয়ের কথা বলছিল। ঐ মেয়েটিকে কি তার পছন্দ?
জানি না মা। ভাইয়া হচ্ছে এমন এক জাতের ছেলে কাউকেই যাদের খুব অপছন্দও হয় না আবার পছন্দও হয় না। এরা পছন্দ করে শুধু নিজেকে আর কাউকে না।
মা হাসতে হাসতে বললেন, তুই বুঝলি কি করে?
আমি বললাম, আমি নিজেও অবিকল ভাইয়ার মত, এই জন্যে বুঝেছি।
সাত দিনের ভেতর বাবার ফেরার কথা, তিনি ফিরলেন না। তার একটা চিঠি এল। এবার পোস্ট কার্ড না। খামে ভরা চিঠি। বিশেষ কাউকে লেখা না। সবার উদ্দেশ্যে লেখা–
পর সমাচার এই যে সুপারি কিনিতে পারি নাই। এইবার সুপারির দর অত্যধিক। ঝড়ে ফলন হয় নাই। অধিকাংশ সুপারির গাছ নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অধিক দামে সুপারি ক্রয় করিতে পারি–তাহাতে খুব লাভ হইবে না। কারণ বেনাপোল দিয়া পার্টনার সুপারি দেশে আসিতেছে। তা দামেও সস্তা। কাজেই সিদ্ধান্ত নিয়াছি খুলনায় যাইব, অন্য কোন ব্যবসার সন্ধান দেখিব। সেখানে মধু সস্তা তবে মধুর তেমন বাজার নাই। প্রচুর বিদেশী মধু দেশে পাওয়া যায়। বিশেষ করিয়া অষ্ট্রেলিয়ার মধু দামেও সস্তা, গুণগত মানও খারাপ না। যাই হউক, এইসব নিয়া তোমরা চিন্তা করিবে না। আমি ভাল আছি। খাওয়া দাওয়া খুব সাবধানে করিতেছি। বাহিরের খাদ্য গ্রহণ করিতেছি না। স্বপাক আহার করিতেছি। আল্লাহর অসীম করুণায় স্বপাক খাইবার ব্যবস্থা হইয়াছে। খুব শীঘ্র তোমাদের সহিত সাক্ষাত হইবে। ইতি …
মার জ্বর সেরে গেছে। তিনি কাজকর্ম শুরু করেছেন। তবে তাকে দেখলে খুব দুর্বল এবং মামরা মনে হয়। তাঁর রাতে ঘুম হয় না। যতবার আমি জাগি, দেখি মা একটা হাতপাখা দুলাচ্ছেন। এই ঘরের একটা সিলিং ফ্যান ছিল, সেটা নষ্ট। ঠিক করানো হচ্ছে না কারণ আমরা আবার টাকা পয়সার কষ্টে পড়ে গেছি। ভাইয়ার শতদল পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেছে। এত খাটাখাটনি করে, ঢাকা শহরের ভ্রাম্যমান পাগল নিয়ে যে লেখাটা সে লিখেছে তা কোথাও ছাপা হয়নি। ঘরে পড়ে আছে। ভাইয়া কাজ জুটানের জন্যে খুব ছোটাছুটি করছে, লাভ হচ্ছে না।
আমি দুলু আপার কাছ থেকে প্রথমে তিনশ পরে দূশ টাকা এনেছি। সেই টাকাও শেষ। চরম দুঃসময়েও আমরা খুব স্বাভাবিক থাকতে পারি, এখন তাই আছি। ভাইয়া ত্যাগের মতই হাসি তামাশা করছে। সেদিন ভাত খাবার সময় বলল, ঢাকা শহরে সবচে সুখে কারা বাস করে জানিস খুকী? ঢাকা শহরে সবচে সুখে আছে–ভ্রাম্যমান পাগলের দল।
কেন?
এদের রোজগার খুব ভাল। যার কাছেই টাকা চায় সেই ভয়ে অস্থির হয়ে টাকা দিয়ে দেয়। পাগল মানুষ, কি করে ঠিক নেই তো। যে কোন রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ালে রেস্টুরেন্টের মালিক কিছু একটা খাবার হাতে ধরিয়ে দেয় যাতে তাড়াতাড়ি বিদেয় হয়। পুলিশ এদের কিছু বলে না। তাদের আছে পূর্ণ স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা।
আপা বলল, ভিক্ষা না করে লোকজন পাগল সাজলেই পারে।
তা পারে। তবে পাগল সাজা খুব সহজ কাজ না। কঠিন কাজ। বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ব্যাপার আছে। পাগল হিসেবে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করার প্রথম শর্ত হচ্ছে সব কাপড় চোপড় খুলে ফেলতে হবে। যাতে দেখামাত্র লোকজন বুঝতে পারে এ পাগল। ঢাকা শহরের ভ্রাম্যমান পাগলদের শতকরা ৭০ ভাগ হল দিগম্বর। বানিয়ে বলছি না। হিসাব করে বলছি।
আমি বললাম, এর মধ্যে নকল পাগল নেই?
আছে। বেশ কয়েকটা নকল পাগল আছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে পাগলামীর অভিনয় করতে করতে অল্পদিনের মধ্যে এরা পাগল হয়ে যায়। এটা বেশ স্ট্রেঞ্জ একটা ব্যাপার।
তুমি দেখি ভাইয়া পাগল বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছ।
তা হয়েছি। বেশ কয়েকটা পাগলের সঙ্গে আমরা খাতিরও হয়েছে। শিক্ষা ভবনের সামনে ছালা গায়ে একটা পাগল বসে থাকে, আমাকে দেখলেই দৌড়ে এসে হাত ধরে টানতে টানতে চায়ের দোকানে নিয়ে যাবে। চা খাওয়াবে। সিগারেট খাওয়াবে।
আসল পাগল না নকল?
ওয়ান হানড্রেড পারসেন খাটি পাগল। এর বাবা এডভোকেট, ভাই বোন আছে। এক বোন গ্রীনলেজ ব্যাংকের ম্যানেজার।
এইসব জানলে কোত্থেকে? পাগল তোমাকে বলেছে?
আরে না। পাগল কোন কথা বলে না। খালি হাসে। এর নাম আমি দিয়েছি হাস্যমুখী। এইসব তথ্য আমি জেনেছি যেখানে চা খাই সেই দোকানের মালিকের কাছ থেকে। পাগলের বাবা ঐ দোকানে খাতা খুলে দিয়েছে। ছেলে যত কাপ চা খায় হিসাব থাকে। মাসের শেষে টাকা দিয়ে যান।
আমি বললাম, ওদের সঙ্গে এত ঘোরাঘুরি করো না তো ভাইয়া। শেষে তুমি নিজেও পাগল হয়ে যাবে।