বিশেষ দিন মানে? কি হয়েছিল এই দিনে?
সে বিরাট ইতিহাস। আরেক দিন বলব।
আরেক দিন বললে হবে না। আজই বলতে হবে।
দেখা গেল–তেমন বিরাট ইতিহাস কিছু না। এই দিনে বাবা মার সঙ্গে প্রথম কথা বলেছেন। সেই কথাও নিতান্ত গদ্য ধরনের কথা। বাবা মার বাড়িতে অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কি করার পর মা দরজা খুললেন। বাবা বললেন, এটা কি জয়নাল সাহেবের বাড়ি?
মা বললেন, হুঁ।
উনাকে একটু ডেকে দাও।
উনি বাড়িতে নাই।
বাবা চলে এলেন এবং আধঘণ্টা পর আবার গেলেন। আবারো একই কথাবার্তা হল। বাবা ফিরে এসে আবার আধঘণ্টা পর গেলেন। এইবার মা হেসে ফেলে বললেন, আপনি বার বার চলে যাচ্ছেন কেন? বসেন। বাবা বসলেন।
ভাইয়া বলল, ঐদিনই কি তোমরা দুজন দুজনের প্রেমে পড়লে?
আহ কি সব প্রশ্ন। তোর মা-কি ঘুমুচ্ছে না-কি? ডেকে তো। বিশেষ দিনটার কথা তোর মার মনে আছে কিনা কে জানে।
বিশেষ দিনটার কথা মারও মনে ছিল। তবে দিনটির প্রসঙ্গে মার বর্ণনা এবং বাবার বর্ণনা এক না। মার কথা মত বাবা পরপর তিনবার জয়নাল সাহেবের খোজ করলেন এবং প্রতিবারই বললেন, এক গ্লাস পানি খাব। শেষবার মা পানি দেন নি। লেবুর সরবত বানিয়ে দিয়েছিলেন। পানি ভেবে বাবা এক চুমুক দিলেন–তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। মুখ তুলে মার দিকে তাকাতেই মা হেসে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন।
মার দৌড়ে পালিয়ে যাবার ব্যাপারটা অবশ্যি আমার অনুমান। ঘটনা এমনই ঘটার কথা। আমার ভেবে খুব অবাক লাগে যে বাবা-মার চরিত্রের অসম্ভব রোমান্টিক দিকটি আমাদের তিন ভাই বোন কারোর মধ্যেই নেই। আপার মধ্যেতো ছিটেফোটাও নেই। ভাইয়ার মধ্যেও নেই–থাকলে দুলু আপার আবেগ তাঁর চোখে পড়ত। আমার নেই এইটুকু বলতে পারি। ছেলেরা যখন ভাব জমানো কথা বলে আমার কেন জানি গা জ্বলে যায়।
আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বান্ধবী আছে, মেরিন। তার বড় ভাই আর্কিটেকচারে ফোর্থ ইয়ারে পড়ে। আমাকে দেখলেই গদগদ ভাব করে। এমন বিশ্রী লাগে! সেদিন বলল, তোমার রেনু নামটা আমার পছন্দ না। তোমাকে এখন থেকে স্বর্ণরেনু ডাকলে কি তোমার খুব আপত্তি আছে?
আমি বললাম, কোন আপত্তি নেই, তবে আমিও এখন থেকে আপনাকে কবীর ভাই না ডেকে ডাকব–তাম্ৰ কবীর ভাই। আপনার আপত্তি নেই তো?
কবীর ভাই খুবই হকচকিয়ে গেলেন। মেয়েরা কথার পিঠে কথা বললে ছেলেরা ঠিক তাল রাখতে পারে না। তাদের চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। অকারণে রাগও করে। কবীর ভাই যে ঐ দিন খুব রাগ করেছিলেন তার প্রমাণ হল পরদিনই মেরিন আমাকে বলল, রেনু তুই আমার ভাইয়াকে অপমান করেছিস, ব্যাপার কি?
আমি বললাম–অপমান করিনি তো।
তুই ভাই, আমাদের বাসায় আর আসিস না। ভাইয়া খুব রাগ করেছে।
আমি মেরিনদের বাসায় আর যাই নি তবে কবীর ভাইয়ের সঙ্গে একদিন রাস্তায় দেখা হল। তিনি রিকশায় করে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন–আমি রাস্তার সবাইকে সচকিত করে ডাকতে লাগলাম–তাম্র ভাই, তাম্র ভাই।
রাগ, দুঃখ এবং বিস্ময়ে বেচারার মুখ কাল হয় গেল। তিনি রিকশা থামালেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, কোন দিকে যাচ্ছেন?
কেন?
আমার পথের দিকে হলে, আপনার সঙ্গে খানিকটা যেতাম। দুপুর রোদে হাঁটতে ভাল লাগছে না।
তুমি কোনদিকে যাবে?
এলিফেন্ট রোড।
আমি ঐদিকে যাচ্ছি না। আর শোন একটা কথা–তাম্র ভাই, তাম্র ভাই করছ কেন?
তাম্র কবীর ভাই বললে অনেক বড় হয়ে যায় এই জন্যে শর্ট করে বলছি। আপনি রাগ করলে আর বলব না।
কবীর ভাই তীব্র দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাপা কাপা গলায় বললেন–বেয়াদবী করবে না। বেয়াদবী করার বয়স তোমার এখনো হয় নি।
আমি কিন্তু বেয়াদবী করতে চাই নি। মজাই করতে চেয়েছিলাম। মজা করারও বোধ হয় বয়স আছে। সব বয়সে মজা করা যায় না। আমি ঠিক করে রেখেছি এর পরে যদি কখনো কবীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় আমি খুব বিনয়ী ব্যবহার করব। হেসে হেসে কথা বলব। এখনো তার সঙ্গে দেখা হয় নি।
বাবা বরিশাল চলে যাবার পর পরই মা অসুখে পড়লেন। তেমন কিছু না, জ্বর।
ভাইয়া বলল, এই জ্বরের নাম হচ্ছে বিরহ-জ্বর। বাবার বিরহে কাতর হয়ে মার জ্বর এসে গেছে। হা-হা-হা।
মার শরীর খারাপ হওয়ায় আমার একটা লাভ হয়েছে–আমি এখন রাতে মার ঘরে ঘুমুচ্ছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাবা যখন থাকেন না তখনো মা তার ঘরে একা থাকেন। আমাকে বা আপাকে তার সঙ্গে ঘুমুবার জন্যে বলেন না। কোন ছোটবেলায় মার সঙ্গে ঘুমিয়েছি মনেই নেই। বড় হয়ে ঘুমুতে এসে লক্ষ্য করলাম, আমার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছে। একটু সংকোচও লাগছে। যেন আমি অনধিকার প্রবেশ করছি। এই ঘরটা মার নিজের একটা জগৎ। এই জগতে আমার বা আমাদের কোন স্থান নেই। ঘরটা মা এবং বাবার।
মার সঙ্গে ঘুমানোর প্রাথমিক সংকোচ দ্বিতীয় রাতেই কেটে গেল। লক্ষ্য করলাম মা এমন ভাবে আমার সঙ্গে গল্প করছেন যেন তিনি আমার একজন বান্ধবী। বাতি নিভিয়ে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, মীরা মাঝে মাঝে খুব কান্নাকাটি করে। কেন করে তুই জানিস?
না।
কাঁদে যে সেটা জানিস?
জানি।
কখনো জিজ্ঞেস করিস নি?
না।
জিজ্ঞেস করা উচিত না?
তুমি যদি বল তাহলে জিজ্ঞেস করব।
থাক, জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। বলার হলে নিজেই বলবে।
এই ভেবেই আমি কিছু জিজ্ঞেস করি নি মা।
ভাল করেছিস। আচ্ছা, রঞ্জু কি বিয়ে টিয়ের কথা কিছু ভাবছে?
জানি না তো মা।