অসুখ বাঁধালে আপনার কি?
আচ্ছা আপনি এমন অবুঝের মত আচরণ করছেন কেন? কথা শুনছেন না কেন?
আমার চিন্তাগুলি হচ্ছে এই রকম কথার পিঠে কথা তৈরি করা। ছেলেমানুষী খেলা। একা থাকলেই আমার এই খেলাটা খেলতে ইচ্ছা করে। সব খেলার শেষেই ক্লান্তি আসে। আমার এই খেলায় কখনো ক্লান্তি আসে না। যাই হোক, যা বলছিলাম–আমি বারান্দায় হাঁটছি–এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছি–তখন হঠাৎ করেই ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনলাম। একজন কে কান্না চাপতে চেষ্টা করছে–পারছে না। আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম–কাঁদছে আপা। এই কান্না প্রচণ্ড কষ্টের কান্না।
আপা কেন এরকম করে কাঁদবে? এমন কি কষ্ট আছে তার? আমি অবাক হয়ে আপার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাতে সে একা একা কাঁদতে পারে এই জন্যেই কি সে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে? এই কারণেই কি তার মাঝে মাঝে একা থাকতে ইচ্ছা করে?
আমি আপার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম, আপা, আপা। কান্না থেমে গেল। আপা কোন উত্তর দিল না।
কাক ডাকছে। ভোর হতে শুরু করেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি আপার ঘরের সামনে। যদিও ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে এতটুকুও ভাল লাগছে না। এই বাড়ির সঙ্গে গাছ গাছালিতে ভর্তি যদি কোন বাগান থাকতো আমি দাঁড়াতাম বাগানের ঠিক মাঝখানে।
পচা মাছের মাথা খেয়ে
পচা মাছের মাথা খেয়ে আমাদের কিছু হলো না, বাবার খুব শরীর খারাপ করল। পেট নেমে গেল, সেই সঙ্গে যুক্ত হল বমির উপসর্গ। ভাইয়া বলল, কলেরা বাঁধিয়ে বসেছ নাকি বাবা?
বাবা ক্ষীণ স্বরে বললেন, বাঁচব না রে। বাঁচব না। আমার দিন শেষ।
বাবার এই ঘোষণায় আমরা বিশেষ বিচলিত হলাম না কারণ সামান্য অসুখ বিসুখেই তিনি এজাতীয় ঘোষণা দেন যা মাকে খুব কাবু করে ফেলে। মা এবারো খুব কাবু হয়ে পড়লেন, ভাইয়াকে কাদো কাদো গলায় বললেন, একটা ভাল ডাক্তার আন। মানুষটা মরে যাচ্ছে দেখছিস না?
ভাইয়া সহজ গলায় বলল, যে কোন ডাক্তারই আসুক বাবাকে স্যালাইন ওয়াটারই দেবে। কাজেই চুপ করে বসে থাক। চিন্তার কিছু নেই। বাবার শরীর থেকে পচা মাছের সর্বশেষ অংশটা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দাস্ত এবং বমি চলতেই থাকবে।
কি করে বুঝলি? তুই কি ডাক্তার?
এসব বুঝার জন্যে ডাক্তার হওয়া লাগে না মা। এগুলি হচ্ছে কমন সেন্স। আমার অন্য কোন সেন্স না থাকলেও কমন সেন্স খুব ভাল। কাল পরশুর মধ্যে দেখবে বাবা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছে।
যদি না বসে?
তখন ডাক্তার আনব।
বড় ডাক্তার আনতে হল না। বাবা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বরিশাল যাবার জন্য। বরিশাল থেকে সুপারি কিনে আনতে হবে। এইটাই নাকি ঠিক সময়।
মা অবাক হয়ে বললেন, এই শরীর নিয়ে তুমি বরিশাল যাবে কি করে?
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি তো আর সাঁতার দিয়ে যাব না। লঞ্চে করে যাব। ডেকে বিছানা করে হাওয়া খেতে খেতে যাব।
মা বললেন, তোমাকে আর ছোটাছুটি করতে হবে না, ঘরে বসে থেকে যা পার কর। সংসার তুমি যতদিন পেরেছ টেনেছ। এখন রঞ্জু টানবে।
বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, ও টানবে কেন? এটা কি ওর সংসার না আমার সংসার? আমার ব্যবসার যা ধারা–ঘরে বসে থাকলে চলবে না জায়গায় জায়গায় যেতেই হবে।
ঠিক আছে। শরীর সারুক তারপর যাবে। এখন রঞ্জুকে গুছিয়ে বলে দাও ও সুপারি কিনে আনবে।
ও সুপারি কি কিনবে? সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। ঢাকা শহরে ভ্রাম্যমান পাগল কত প্রকার ও কি কি ওকে জিজ্ঞেস কর–ও বলে দেবে। সুপারির দর জিজ্ঞেস কর বলতে পারবে না।
শরীর পুরোপুরি না সারতেই বাবা বরিশাল যাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। আমরা সবাই প্রবল আপত্তি করলাম। শুধু আপা বলল–বাবা বাইরে গেলে ভালই হবে। অনেকদিন ঘরে থেকে মনটন খারাপ হয়ে আছে। আগের মত ঘোরাঘুরি শুরু করলে শরীর আরো তাড়াতাড়ি সারবে।
বাবার সবগুলি প্যান্ট ঢিলা হয়ে গেছে। পিছলে পড়ে যায়। বেল্ট নেই কাজেই পায়জামার দড়ি দিয়ে প্যান্ট পরা হল। তিনি এক হাতে স্যুটকেস অন্য হাতে দুটির ছোট্ট টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বিকেল চারটায় রিক্সায় উঠে বসলেন। তাঁর লঞ্চ দু টায়। ট্রাফিক জামে পড়ে যেন লঞ্চ মিস না করেন সে জন্যেই এত সাবধানতা।
চার দিনের মাথায় চলে আসব। খুব বেশী হলে এক সপ্তাহ। চিন্তার কোন কারণ নাই–আল্লাহ হাফেজ।
বাবা বাড়ি থেকে বেরুলেই মা মন খারাপ করেন। এবার অনেক বেশী মন খারাপ করলেন কারণ আগের রাতে তিনি নাকি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। মার দুঃস্বপ্নগুলি সাধারণত খুব জটিল হয়।
এটা তেমন জটিল না।
এক অন্ধ লোক ভিক্ষা চাইতে এসেছে। বাবা ভিক্ষা দিতে যাচ্ছেন, মা আপত্তি করছেন–ওর কাছে যেও না, ও আসলে ভিক্ষুক না, খুনী। ও তোমাকে খুন করবে। বাবা মার কথা শুনলেন না। কাছে গেলেন। অন্ধলোকটা তখন বিকট শব্দে হেসে উঠল। মার ঘুমও ভেঙ্গে গেল।
বাবার রিকশা বড় রাস্তায় পড়ার আগেই মা আমাদের কাজের মেয়েটিকে একটা কালো রঙের মুরগী কিনতে পাঠালেন। আগামীকাল ভোরে এই মুরগী কোন একজন অন্ধ ভিখারীকে ছদকা দেয়া হবে।
রাত বারোটার দিকে আমরা সবাই যখন ঘুমুতে যাচ্ছি–বাবা এসে উপস্থিত। ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, ব্যাপার কি? বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ব্যাপার কিছু না। হঠাৎ একটা জিনিস মনে পড়ল চলে এলাম।
কি মনে পড়ল?
না মানে, আগামীকাল দিনটা একটা বিশেষ দিন। ভুলেই গিয়েছিলাম …. লঞ্চে উঠে মনে পড়ল, চলে এলাম। একদিন পরেই যাই একদিনে কি হবে?