ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না–
ওকে দাও ছেড়ে দাও ছেড়ে…
দুলু আপার অসংখ্য রের্কড কিন্তু গভীর রাতে তিনি অল্প কিছু গান ঘুরে ফিরে বাজান। কোন কোন রাতে এমন হয় যে একই গান বার বার বাজাচ্ছেন। কে জানে আজ হয়ত এই গানটাই পঞ্চশবার বাজাবেন।
বসে থাকতে থাকতে আমার ঝিমুনি ধরে গেল। ভাইয়ার ঘরের দরজা বন্ধ বলেই বারান্দা অন্ধকার হয়ে আছে। এখন বেশ বাতাস ছেড়েছে। বারান্দায় পাটি পেতে ঘুমুতে পারলে ভাল হত। আকাশে মেঘ করেছে। কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকাল। বৃষ্টি নামলে খুব ভাল হয়। আরাম করে ঘুমানো যায়। এবার গরমটা বেশী পড়েছে। ভাইয়া ভেতর থেকে চেঁচাল।
ও খুকি চা দে।
আমি আবার চা বানিয়ে আনলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। দুলু আপা একই গান বারে বারে বাজাচ্ছেন–
ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না–
ওকে দাও ছেড়ে দাও ছেড়ে…
ভাইয়া চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, আমাকে যদি বলতো ঢাকা শহরের গৃহবন্দী পাগলের উপর প্রচ্ছদ কাহিনী লিখতে–আমি সবার প্রথমে লিখতাম তোর দুল আপার কথা। দেখ একই গান বার বার বাজাচ্ছে। এই ভাবে মানুষকে বিরক্ত করার কোন মানে হয়?–ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না … কান ঝালাপালা হয়ে গেল। যাকে ধরিলে ধরা দেবে না তাকে ধরার জন্যে এত মাতামাতি কেন? ছেড়ে দাও চড়ে খাক। ইশ কি বিরক্ত যে এই মেয়েটা করে।
তুমি জেগে আছ তাতে আর উনি জানেন না? তোমার লেখা এগুচ্ছে কেমন?
মোটেই এগুচ্ছে না। শুরুটা নিয়েই সমস্যা–একটা ইন্টারেস্টিং ওপেনিং দরকার–সেটা পারছি না। যাকে বলে শুরুতেই পাঠককে একটা চমক দেয়া–দেখ তো এই শুরুটা তোর কাছে কেমন লাগে–তুই পড়বি না আমি পড়ে শোনাব?
তুমিই পড়ে শোনাও। তোমার হিজিবিজি হাতের লেখা আমি পড়তে পারি না।
ভাইয়া পড়তে শুরু করল–ধরুন, আপনি ঢাকা শহরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ দেখলেন পুরোপুরি নগ্ন একজন মানুষ আইল্যাণ্ডে পঁড়িয়ে হাত তুলে ট্রাফিক কনট্রোল করছে। ট্রাফিক পুলিশ যে ভাবে বাঁশি বাজায় সেই ভাবেই পিপ পিপ করে মুখে বাঁশি বাজানোর আওয়াজ করছে–তখন আপনি কি করবেন? বিরক্ত হবেন? তার সিগন্যাল উপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে পার হয়ে যাবেন নাকি সিগন্যাল মানবেন?
নওয়াবপুর রোডের মোড়ে এক পাগল ট্রাফিক কনট্রোল করে–যার সিগন্যাল সবাই মানে। সে যখন হাত উঠিয়ে গাড়ি থামতে বলে তখন সব গাড়ি থামে। চলতে বললে চলে। বদ্ধ উন্মাদি এই ব্যক্তি ট্রাফিক কনট্রোল করে খুব সুন্দর ভাবে। মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ তার কাছে দায়িত্ব দিয়ে চা-টা খেতে যায়। খুকি ঘুমিয়ে পড়েছিস?
না–শুনছি।
কেমন লাগছে?
ভাল। সত্যি এমন কেউ আছে নাকি?
অবশ্যই আছে। আমি তো গল্প লিখছি না। সত্য অনুসন্ধানী রিপোর্ট। আভা যখন এই লোকটার কথা বলল তখন আমি নিজেও বিশ্বাস করি নি। আভা আমাকে নিয়ে গেল। পাগলটার সঙ্গে কথাটথা বললাম। ভেরী ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার।
সত্যি পাগল?
হুঁ–যাই জিজ্ঞেস করি হাসে আর বলে–খিস খিস।
ভাইয়া আমি বারান্দায় চাদর পেতে শুচ্ছি–তোমার লেখা শেষ হলে আমাকে ডেকে দিও।
তোকে মনে হয় কষ্টের মধ্যে ফেললাম–কুলি ছুটি আছে সারাদিন ঘুমুতে পারবি। আজ একটু কষ্ট কর। শেষ বারের মত এক কাপ চা নিয়ে আয়।
চা এনে দেখি লেখা খাতার উপর মাথা রেখে ভাইয়া ঘুমুচ্ছে–।
ভাইয়াকে জাগালাম না। বাতি নিভিয়ে দিলাম। ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা বাজে। এখন আর ঘুমুতে যাবার কোন মানে হয় না। ঘুম আসতে আসতে আধঘণ্টা লাগবে। তারপর যেই ঘুমটা আসবে, ভোর হবে। ঘরে রোদ ঢুকে যাবে। জেগে উঠতে হবে। আধঘণ্টা, একঘণ্টা ঘুমুনোর চেয়ে না ঘুমানো ভাল।
আমি বারান্দায় চলে এলাম। এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছি। চারদিক নীরব। দুলু আপা গান বাজানো বন্ধ করেছেন। যাকে তিনি ধরতে চাচ্ছেন তাঁকে ধরবার আশা ছেড়ে দিয়ে তিনি সম্ভবত ঘুমুতে গেছেন।
এইখানে আমি আপনাকে একটা কথা বলি–সারারাত জেগে থাকার বিশ্রী অভ্যাস আমার আছে। কোনই কারণ নেই অথচ আমার ঘুম আসছে না। আমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছি এ রকম প্রায়ই হয়। হাঁটাহাঁটি করতে করতে আমি অনেক কিছু চিন্তা করি। আমার খুব ভাল লাগে। কি নিয়ে চিন্তা করি তার সব আপনাকে বলা যাবে না। আপনি হাসবেন। এবং মনে মনে বলবেন–মেয়েটা তো ভারী ইয়ে।
শুধু একটা চিন্তার কথা বলি–চিন্তা না–কল্পনা। আমি কল্পনা করি যেন রাতের ট্রেনে আমি যাচ্ছি। কামরায় দুটি মাত্র মানুষ। আমি এবং একটি ছেলে। ছেলেটিকে আমি আগে কখনো দেখিনি। অল্প বয়স, সুন্দর চেহারা। বড় বড় চোখ। চোখে চশমা। খুব বৃষ্টি নেমেছে। ছেলেটা ট্রেনের কমিরর জানালা বন্ধ করছে। আমার জানালাটা খোলা। সে বিরক্ত হয়ে বলল, জানালা বন্ধ করছেন না কেন?
আমি বললাম, তাতে আপনার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে?
আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন।
আমাকে শুকনা রাখার দায়িত্ব তো আপনাকে দেয়া হয় নি। আমার বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা হচ্ছে–ভিজছি …।
এই কথায় ছেলেটা একটু যেন আহত হল। নিজের দিকের জানালা খুলে সেও আমার মত জানালা দিয়ে মাথা বের করে ভিজতে লাগল। আমি বললাম, আপনি ভিজছেন কেন?
ইচ্ছে হচ্ছে ভিজছি।
আপনার অসুখ করতে পারে। বৃষ্টির পানি সবার সহ্য হয় না। আমার অভ্যাস আছে। আমার কিছু হয় না।
আমারো অভ্যাস আছে। আমারো কিছু হয় না।
না আপনার অভ্যাস নেই। অভ্যাস থাকলে বৃষ্টি নাম মাত্র খটাখট জানালা বন্ধ করতেন না। তাছাড়া আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি শীতে আপনি কাঁপছেন। নির্ঘাৎ অসুখ বাঁধাবেন।