রান্নার এক ফাঁকে মা এসে আমাকে আর আপাকে চুপি চুপি বলে গেলেন, মাছের মাথাটা পচা ছিল–খেতে ভাল হবে না। তোর বাবাকে কিছু বলিস না, মনে কষ্ট পাবে। বেচারা শখ করে কিনেছে।
আপা বলল, পচা মাছ খেয়ে তো অসুখ করবে মা।
এত পচা না। কষ্ট করে খেয়ে নিস মা–
খাবার সময় মোটামুটি করুণ দৃশ্যের অবতারণা হল বলা যেতে পারে–বাবা নিজেই মাছ মুখে দিতে পারলেন না–মুখ কুঁচকে বললেন–মাথাটা পচা নাকি?
মা বললেন, না তো। টাটকা মাথা। কানকো লালটকটকে ছিল।
খেতে এমন লাগছে কেন? পচা গন্ধ পাচ্ছি।
আমি বললাম, তুমি উল্টা-পাল্টা ডিরেকশন দিয়ে মাছটা নষ্ট করেছ বাবা।
আপা বলল, আমার কাছে খেতে তো ভালই লাগছে।
বাবা বললেন, খেতে খারাপ হয় নি। গন্ধটা ডিসটার্ব করছে। রঞ্জু থাকলে এই গন্ধ নিয়ে কিছু একটা বলে সবাইকে হাসিয়ে মারত। ও কি রোজ ফিরতে দেরী করে?
আমি বললাম, মাঝে মাঝে করে।
এটা ঠিক না। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। ঢাকা শহর এখন আগের মত সেফ না–। রাত বিরেতে চলাচল বন্ধ করতে হবে। আমি আজ ওকে বলব। কড়া গলায় বলব–অবশ্যি তাকে কড়া গলায় কিছু বলাও মুশকিল। ফানি ম্যান। এমন কিছু বলবে যে হাসতে হাসতে জীবন যাবে।
বলেই বাবা হাসতে লাগলেন। সেই হাসি থামতে সময় লাগল। হাসি থামে, দুএক নলা ভাত খান। আবার হাসেন।
ভাইয়া ফিরল রাত দেড়টায়। ঘরে ঢুকেই বলল, খুকী জেগে আছিস? আমার দুটা ডাক নাম, একটা খুকী, অন্যটা রেনু। খুকি নামে এখন কেউ ডাকে না, আমি নিষেধ করে দিয়েছি। কেউ যদি ভুল করেও ডাকে আমি রাগারাগি করি। শুধু ভাইয়া ডাকে। আমাকে রাগাবার জন্যেই ডাকে। রাগ করলে আরো বেশী ডাকবে বলে চুপ করে থাকি। ভাইয়া সার্ট খুলতে খুলতে বলল, কথা বলছিস না কেন? জেগে আছিস না-কি?
না ঘুমিয়ে আছি। আচ্ছা ভাইয়া, এত দেরী করলে? বাবা তোমার জন্যে এতক্ষণ জেগেছিলেন। রাতে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আমরা ভাত খেয়েছি এগারোটার সময়।
মেনু ছিল কি?
মাছের মাথা–মুড়িঘণ্ট। বাবা নিজে মাথা কিনে আনলেন।
ভাইয়া শুকনো গলায় বলল, নিশ্চয়ই পচা ছিল। আজ পর্যন্ত কোনদিন বাবা টাটকা মাথা কিনতে পারেন নি। আমি একশ টাকা বাজি রাখতে পারি, মাথাটা ছিল পচা তোরা কেউ খেতে পারিস নি।
মাথা ভালই ছিল। ভাইয়া তুমি কি খেয়ে এসেছ না খাবার গরম করব?
খেয়ে এসেছি–আভা আজ তাদের বাসায় নিয়ে গেল। আভার মা খাইয়ে দিলেন।
কোন আভা?
এমন ভাবে বললি যেন দশ বারোটা আভার সঙ্গে আমার খাতির। কথাবার্তা চিন্তা-ভাবনা করে বল। প্রশ্ন করতে হয় বলেই যে বলতে হবে–কোন আভা?
তাতো ঠিক না।
সরি।
সরি হলে ভাল–তুই এখন যা, আমার জন্য ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা বানিয়ে আন। আজ সারারাত জাগতে হবে। পত্রিকায় একটা ভাল এ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছি। প্রচ্ছদ কাহিনী–বিষয় হল, ঢাকা শহরে ভ্রাম্যমান পাগল। ঠিকঠাক মত নামতে পারলে এক হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আভা আমাকে সাহায্য করছে। ও নেৰে চারশ–আমি দুশ …।
আভা নামের মেয়েটির কথা ভাইয়ার মুখে কয়েকবার শুনেছি, এখনো দেখিনি। আমাদের বাসায় কখনো আসেনি। মেয়েটা শতদল পত্রিকায় কাজ করে। ভাইয়ার ভাষায় খুব ফাইটিং টাইপ মেয়ে–বেঁচে থাকার জন্য ফাইট দিয়ে যাচ্ছে। মানি প্ল্যান্ট জাতীয় মেয়ে না–ছোট ছোট তিনটা ভাই বোন, অসুস্থ মা–সে একা রোজগার করছে। দিন রাত পরিশ্রম করছে।
কি রে খুকি এখনো দাঁড়িয়ে আছিস, ব্যাপার কি? চা নিয়ে আয়। ফ্লাস্ক ভর্তি করে আনবি?
ফ্লাস্ক পাব কোথায়?
ঐদিন যে একটা দেখলাম?
দুলু আপাদের ফ্লাস্ক।
ও আচ্ছা, তাহলে তো তোর কাজ বেড়ে গেল। তোকেও জেগে থাকতে হবে–ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমাকে চা খাওয়াতে হবে। ছোট বোন হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রণা।
আমি বললাম, আভা মেয়েটা দেখতে কেমন?
ভেরি অর্ডিনারী। সাজলে জলে হয়ত সুন্দর দেখাবে। সাজার সময় কোথায়? সাজতে তো পয়সাও লাগে। পয়সা কোথায়? একটা মাত্র ঘর সাবলেট নিয়ে এতগুলি মানুষ থাকে। কি ভাবে বাস করে না দেখলে বিশ্বাস করবি না। আমি ওদের বাসায় গিয়ে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলাম, বুঝলি খুকী? আমার ধারণা ছিল–আমরাই বোধ হয় সবচে গরীব। ওদের বাড়িতে রাতে কি রান্না হয়েছে জানিস–শুধু ভাত আর ডাল। স্বাস্থ্যবান ভাত ইয়া মোটা মোটা।
তুমি ডাল ভাত খেয়ে এলে?
না, আভা গিয়ে আমার জন্যে ডিম কিনে নিয়ে এল। সেই ডিম ভাজা হল। আভার একটা ছোট বোন আছে তার নাম শেফা। সে খুব গোপনে ফ্রকের আড়ালে একটা বাটি নিয়ে গেল পাশের বাড়ি। সেখান থেকে খানিকটা মাছের তরকারীও এল।
ভাইয়া হাত-মুখ ধুয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি চা বানিয়ে আনলাম। ভাইয়া বলল, এক কাজ কর তো খুকী। তোর ফ্যানটা আমাকে ধার দে। বড় বেশী গরম। আর শোন, একটা গামছা ভিজিয়ে আমার পিঠের উপর দিয়ে দে। তাহলে মশা বিশেষ কায়দা করতে পারবে না। শরীরটাও ঠাণ্ডা থাকবে।
আমি ভাইয়ার পিঠে ভেজা গামছা দিয়ে বারান্দায় মোড়া পেতে বসলাম। ঘরে আলো থাকলে আমার ঘুম হয় না। এরচে বারান্দায় বসে থাকা ভাল। বারান্দায় খানিকটা বাতাস আছে। বসে থাকতে খুব খারাপ লাগছে না।
আমি চুপচাপ বসে আছি। দুলু আপা গান বাজনো শুরু করেছেন। তার মন খারাপ ভাবটা সম্ভবত কেটেছে। একজন মানুষ বেশীক্ষণ যেমন মন ভাল রাখতে পারে না–বেশীক্ষণ মন খারাপও রাখতে পারে না। তিনি নিশ্চয়ই খাওয়া-দাওয়াও করেছেন। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কেউ গান শুনতে পারে না। সংগীত ক্ষুধার্ত মানুষের বিষয় নয়।