- বইয়ের নামঃ আশাবরী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
তিন মাস ধরে কোন আয়না নেই
“যদি আজ বিকেলের ডাকে
তার কোন চিঠি পাই?
যদি সে নিজেই এসে থাকে
যদি তার এতকাল পরে মনে হয়
দেরি হোক, যায়নি সময়?”
০১.
জানেন, আমাদের বাসায় গত তিন মাস ধরে কোন আয়না নেই। ঠাট্টা করছি। সত্যি নেই। একমাত্র আয়নাটা ছিল বাবার ঘরে। ড্রেসিং টেবিল নামের এক বস্তুর সঙ্গে লাগানো। একদিন সন্ধ্যায় বিনা নোটিশে সেই আয়না ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে গেল। অভ্যাসের বশে আমরা এখনো ড্রেসিং টেবিলটার সামনে দাঁড়াই। যেখানে আয়না ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের দেখতে চেষ্টা করি। ভুল ধরা পড়া মাত্র খানিকটা লজ্জা পাই। শুধু ভাইয়া এমন ভাব করে যেন সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে, আয়না থাকলে আমরা যে ভাবে মাথা এদিক ওদিক করে চুল আঁচড়াই সেও তাই করে।
মজার ব্যাপার কি জানেন, ঘরে যে আয়না নেই এ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথাও নেই। আপা সব কিছু নিয়ে কঠিন গলায় কথা বলে, এ ব্যাপারে একটি কথাও বলছে না। ভাইয়াও চুপ। অথচ সংসারের দায়দায়িত্ব এখন অনেকখানি তার। পুরুষ মানুষ বলতে সে একা। বাবার কোন খোঁজ নেই। কোথায় আছেন আমরা জানি না। তাকে নিয়ে আমরা তেমন চিন্তিতও নই। মাঝে মাঝে ডুব দেয়া পুরানো অভ্যাস। বাবার ব্যবসা যখন খারাপ চলে, সংসারে টাকা পয়সা দিতে পারেন না তখন উধাও হয়ে যান। মাসখানিক পর একটা পোস্টকার্ড এসে উপস্থিত হয়। পোস্টকার্ডের এক পিঠে সম্বোধনহীন চিঠি। যে চিঠিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা হয়–পর সমাচার এই যে ব্যবসার কারণে আমাকে সুনামগঞ্জে আসিতে হইয়াছে। এক ঠগবাজের পাল্লায় পড়িয়া সামান্য অর্থনৈতিক ঝামেলায় পড়িয়াছি। তোমরা কোনমতে চালাইয়া নাও। যথা শীঘ্ন চলিয়া আসিব। চিন্তার কোন কারণ নাই।
যদিও লেখা থাকে সুনামগঞ্জ থেকে লিখছি কিংবা চাঁদপুর থেকে লিখছি তবু আমাদের সবার ধারণা তিনি লেখেন ঢাকায় বসেই কারণ পোস্টকার্ডে সুনামগঞ্জ কিংবা চাদপুরের কোন সীল থাকে না। একবার চিঠিতে লিখলেন যশোহর থেকে লিখছি। ওমা সেই চিঠি পরের দিন এসে উপস্থিত। ভাইয়া শার্লক হোমসের মত চিঠির ঠিকানা থেকে এই তথ্য বের করল এবং মাকে ক্ষেপাবার জন্য বলতে লাগল–সন্দেহজনক। খুবই সন্দেহজনক।
বাবা উধাও হলে টাকা পয়সার বড় রকমের সমস্যা হয়। তখন সংসার কি ভাবে চলে আমি জানি না। তবে আমাকে কলেজে যাবার সময় ঠিকই দশটাকা হাতখরচ দেয়া হয়।
টাকাটা নিতে লজ্জা লাগে তবু আমি আমার অভ্যাস মত বলি–আরো দশটা টাকা দাওনা মা প্লীজ। মা বিস্ময় এবং ব্যথিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। হয়ত মনে মনে ভাবেন তার এই মেয়েটা এত বোকা? কিছুই বুঝে না? আমি ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকি–দাও না মা প্লীজ। প্লীজ। দশ টাকাতো রিকশা ভাড়াতেহ চলে যাবে। দুপুরে না খেয়ে থাকব?
এ রকম ঘ্যান ঘ্যান করা, সবকিছু বুঝেও না বোঝা আমার অভ্যাস। মানুষের অভ্যাস কি চট করে যায় আপনি বলুন? আয়না নেই জেনেওতো আমরা আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছি। দাঁড়াচ্ছি না সবই অভ্যাস। যেমন ভাইয়ার অভ্যাস হচ্ছে রসিকতা করা এবং দার্শনিক ধরনের কথাবার্তা বলা। তার যদি কোন কারণে ফাসি হয় আমার ধারণা সে ফঁসির দড়ির কাছে গিয়ে চিন্তিত গলায় বলবে–দড়ি তো খুব পলক। মনে হচ্ছে–ছিড়ে পড়ে যাবেন। তো ভাই? আমার ওজন কিন্তু অনেক বেশী–একশ পঞ্চাশ পাউণ্ড রোগা পটকা চেহারা দেখে বিভ্রান্ত হবেন না।
ভাইয়া তার রসিকতার অভ্যাস কিছুতেই বদলাতে পারবে না। আমার ধারণা তার মৃত্যুর সময়ও সে কোন না কোন রসিকতা করে আমাদেরতো হাসাবেই যে আজরাইল তার জীবন নিতে আসবে তাকেও হামাবে। একবার কি হল শুনুন, ভাইয়ার প্রচণ্ড জ্বর। ঘরে থার্মোমিটার নেই কাজেই কত জ্বর তা বুঝতে পারছি না। আমি গ্রীণ ফার্মেসীর ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনলাম। তিনি জ্বর মেপে আঁতকে উঠলেন–একশ পাঁচ। এক্ষণি শাওয়ারের নীচে বসিয়ে দিতে হবে, ক্রমাগত পানি ঢালতে হবে।
ভাইয়া আমাকে বলল, ও রেনু যাতে এক কেতলি পানি এনে আমার মাথার উপর বসিয়ে দে। পানি ফুটলে সেই পানিতে চা বানিয়ে আমাকে খাওয়া–মাছের তেলে মাছ ভাজা কাকে বলে দেখিয়ে দিচ্ছি। নিজের টেম্পারেচারে নিজের ফুড প্রিপারেশন।
ভাইয়ার রসিকতায় আমরা সবাই হাসি। সবচে বেশী হাসেন আমার বাবা। হাসতে হাসতে বলেন–ফানি ম্যান। ভেরী ফানি ম্যান।
শুধু আপা হাসে না। মুখ কঠিন করে বলে, গোপাল ভাঁড়। আপার ব্যাপার আমি ঠিক বুঝি না–যেখানে খুশী হওয়া উচিত সেখানে সে বেজার হয়। রাগ করার কোনই কারণ নেই এমন সব জায়গায় সে রাগ করে।
আপা অসম্ভব রূপবতী। নিজের বোন না হয়ে অন্যের বোন হলে আমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরে যেতাম। তার চোখ সুন্দর, গায়ের রঙ সুন্দর, নাক মুখ সবই সুন্দর। না আমি মোটেই বাড়িয়ে বলছি না একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। আপা যখন ইডেন কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পরে তখনকার ঘটনা। সন্ধ্যা হয়েছে। আমরা সবাই বসে চা মুড়ি খাচ্ছি, বিরাট একটা গাড়ি এসে বাসার সামনে থামল। দুজন অপরিচিত ভদ্রলোক এলেন। তারা বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান। শুনলাম তাঁরা সিনেমার লোক। নতুন ছবি বানাচ্ছেন–ছবির নাম বোনের সংসার। ছবিতে একজন টিন এজ নায়িকা থাকবে। দর্শকদের নতুন মুখ উপহার দেয়া হবে। মীরা আপা হচ্ছে সেই নতুন মুখ। এখন বাবা রাজি হলেই হয়। তাঁরা দশ হাজার টাকা সাইনিং মানি নিয়ে এসেছে।