বলার মতো নয়। সত্যি কথা বলতে কী যেটুকু অবাক হল খুশি হল তার চাইতে অনেক বেশি। নিতুকে জাপটে ধরে মিতুল বলল, তুই-তুই-তুই মানে তুমি—
আমি কী?
আমি শীওর ছিলাম কুকুরটা তোমাকে দেখে ফেলবে তারপর ধরে কাচা খেয়ে ফেবে। খোরাসানী ম্যাডামের বাঘের মতো একটা কুকুর আছে। কাউকে পেলে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে!
যা! নিতু হেসে বলল, কী সুইট কুকুরটা।
রেবেকা চাপা গলায় বলল, সুইট! তুই দেখেছিস কুকুরটাকে?
দেখব না কেন! কুকুরটাকে পেয়ে গেলাম বলেই তো বেশি ভয় পাই নাই। আমার সাথে ছিল সারাক্ষণ। নাম দিয়েছি ললিপপ।
ললিপপ! রুনু (কিংবা ঝুনু। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। তুই—মানে তুমি, মানে তুই নাম দিয়েছিস ললিপপ?
হ্যাঁ। কুকুরকে আমার যা ভালো লাগে!
ভালো লাগে? ঝুনু (কিংবা রুনু) চোখ কপালে তুলে বলল, তোর ভয় লাগে না?
নিতু আবার হেসে ফেলল, বলল, ধুর বোকা! কুকুরকে ভয় লাগবে কেন? ভয় লাগলে লাগতে পারে মানুষকে পশুপাখিকে কোনো ভয় নাই। কুকুর হচ্ছে ছোট বাচ্চার মতো। আদর করলেই বাধ্য হয়ে যায়।
তানিয়া মাথা নেড়ে বলল, তুমি বলছ যে সিংঘি তোমার বাধ্য হয়ে গেছে?
সিংঘি! নিতু অবাক হয়ে বলল, এত সুইট একটা কুকুরের নাম দিয়েছে সিংঘি? কী সর্বনাশ!
ঠিক এই সময়ে বারান্দায় খ্যাস খ্যাস করে সেন্ডেলের শব্দ হল এবং সাথে সাথে সবাই নিঃশব্দে নিজেদের বিছানায় ঢুকে গেল। সেন্ডেলের শব্দ তাদের ঘরের সামনে এসে থেমে যায় তারপর আবার ফিরে গেল, ঠিক কোন ঘর থেকে কথাবার্তা আসছে চিমশে যাওয়া তাড়ানো হোস্টেল সুপার মনে হয় ধরতে পারল না।
নিতু রাতে ভোটকা মিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল, ফিস ফিস করে বলল, বুঝলে ভোটকা মিয়া তোমার আর ভয় নাই! দিনের বেলা তোমাকে অবিশ্যি লুকিয়ে থাকতে হবে, কিন্তু সেটা আর কঠিন কী? তুমি চুপ করে লুকিয়ে থেকো—কোনো শব্দ করো না। এখন অনেক রাত হয়েছে ভোটকা মিয়া, ঘুমিয়ে যাও।
নিতু ঘুমানোর জন্যে চাদরটা গায়ে টেনে আনতে গিয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করল তার কাপড়ের একটা অংশ ছেড়া। শুধু ছেড়া নয়, ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গেছে। ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করতে যাওয়ার সময় কোনো এক জায়গায় ছিঁড়ে রয়ে গেছে। নিতুর বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠল।
ঠিক এই রকম সময়ে হোস্টেলের বুয়া রবোট মহিলা জমিলার মা তার বিছানায় বসে ঠক ঠক করে কাপতে কাপতে আয়াতুল কুরসি পড়ছিল। বাথরুমে যাওয়ার জন্যে ঘর থেকে বের হয়ে সে স্পষ্ট দেখেছে একটা পরী আকাশ থেকে নেমে দেওয়ালের কাছে আঁপড়া ছাতিম গাছটিতে এসে বসেছে। খিল খিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে গাছ থেকে নেমে আসছে। আর কী আশ্চর্য, সেই পরী যাদু করে খোরাসানী ম্যাডামের ভয়ংকর কুকুরটাকেও বশ করে ফেলেছে। যে কুকুরটা কাউকে পেলে কামড়ে টুকরো টুকরো করে ফেল্লার কথা সেটা সেই পরীর সাথে খেলছে! তাকে ঘিরে ঘিরে নাচছে।
জমিলার মা ভয়ে জ্ঞান প্রায় হারিয়ে ফেলছিল, তার মাঝে অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে ঘরের মাঝে ফিরে গিয়ে বিছানায় বসে রইল।
০৪. স্লীপ ওয়াকিং
ক্লাশ শুরু হওয়ার আগে এসেমব্লিতে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কী কারণ কারো জানা নেই এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে কয়েকবার হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে ব্যায়াম করতে হয়। ব্যায়াম শেষ করে সবাই এখন ক্লাশরুমে যাবে, ঠিক তখন খোরাসানী ম্যাডাম দুই পা এগিয়ে এসে হুংকার দিয়ে বলল, চামচিকার দল। ছারপোকার ডিম। ইঁদুরের বাচ্চারা
এটি নূতন কিছু নয়, খোরাসানী ম্যাডাম গালি না দিয়ে কথা বলে না, কাজেই এর পরে কী বলবে শোনার জন্যে সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, জমিলার মা বলেছে কাল রাতে ছাতিম গাছটাতে নাকি একটা পরী নেমেছিল। সে নিজের চোখে দেখেছে।
নিতুর বুকটা ধ্বক করে উঠে, হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ যেন লাফিয়ে গলার কাছে এসে ঢোল বাজানোর মতো শব্দ করতে থাকে। খোরাসানী ম্যাডাম জল্লাদের মতো সামনে দিয়ে একবার হেঁটে গিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, জীন পরী এত জায়গা থাকতে বুতুরুন্নেসা স্কুলে হাজির হল কেন?
কেউ কোনো কথা বলল না।
সকাল বেলা আমি ছাতিম গাছটা দেখতে গিয়েছিলাম। পরী ভুল করে তার পাখা ফেলে গিয়েছে কী না দেখতে। খোরাসানী ম্যাডাম আরেকবার সামনে দিয়ে হেঁটে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, কী দেখেছি জানিস ছারপোকার দল, হুকওয়ার্মের ছাও?
নিতু এবং তার পাঁচ রুমমেট ছাড়া অন্য সবার মাঝে সূক্ষ্ম কৌতুহল জেগে উঠলেও কেউ কোনো কথা বলল না। খোরাসানী ম্যাডাম তার কেঁদো বাঘের মতো মুখটাকে আরো ভয়ংকর করে হাত উপরে তুলে মুঠিটা খুলে ফেলল, নিতু দেখল তার ঘুমের কাপড়ের ছেড়া অংশটুকু হঠাৎ করে তার মনে হল সে বুঝি হাঁটু ভেঙ্গে ধড়াস করে পড়ে যাবে। অনেক কষ্ট করে নিতু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, এইটা কার কাপড়ের টুকরা? এক্ষুনি বল, না হলে আমি তোদের সবাইকে এই খানে নীল ডাউন করিয়ে রেখে ঘরে ঘরে গিয়ে তোদের কাপড় চেক করে দেখব। এটা যার কাপড়ের টুকরা তাকে আমি–
খোরাসানী ম্যাডাম কথা শেষ না করে মুণ্ডু ছিঁড়ে নিয়ে ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ হাঁ করে কোৎ করে গিলে ফেলার ভঙ্গি করল এবং ব্যাপারটি কারো কাছে এতটুকু অসম্ভব বলে মনে হল না।
নিতু ঘামতে শুরু করল, সত্যি সত্যি যদি ঘরে ঘরে গিয়ে কাপড় চেক করতে শুরু করা হয় তাহলে সে ধরা পড়ে যাবে। শুধু যে সে ধরা পড়বে তাই নয়, কাপড় খুঁজতে গিয়ে যখন ভোটকা মিয়াকে পেয়ে যাবে তখন কেন সে মাঝ রাতে ছাতিম গাছে উঠেছিল সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকবে না। সে নিজে যদি এখন স্বীকার করে একটা গল্প ফেঁদে বসে–