আমি নিতু।
কোথায় যাস?
নিতু চাপা গলায় বলল, হোস্টেল সুপারের ঘরে।
সে কী! কেন? মিতুল তার বিছানায় উঠে বসল।
ইঁদুরের বাচ্চাটা ছেড়ে দিয়ে আসি, কী একটা মজা হবে না?
মিতুল এবার পুরোপুরি জেগে উঠল, চাপা গলায় বলল, তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে?
মাথা খারাপ হবে কেন? হোস্টেল সুপার ইঁদুরকে কী ভয় পায় জানিস না? যখন গা বেয়ে উঠে যাবে— বাকিটা চিন্তা করে নিতু অন্ধকারে হি হি করে হাসতে থাকে।
মিতুল কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আবছা অন্ধকারে নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সে নিজেও হি হি করে হাসতে শুরু করে। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, সাবধানে যাবি, ধরা পড়লে কিন্তু বিপদ আছে।
চিন্তা করিস না তুই। নিতু সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে এল। বারান্দায় আলো জ্বলছে, হঠাৎ করে কেউ দেখে ফেললে বলবে বাথরুমে যাচ্ছে। হাতে ইঁদুরের বাচ্চাটা নিয়ে নিতু নিশব্দে হাঁটতে থাকে। কয়েকটা রুম পার হবার পরই দূর থেকে হোস্টেল সুপারের বাঁশির মতো নাক ডাকা শুনতে পেল। আরো খানিকদূর যাবার পর বুঝতে পারে নাক ডাকার শব্দটি ঠিক বাঁশির মতো নয় অনেকটা প্লেনের ইঞ্জিনের মতো অনেক দূর থেকে সেটাকে বাঁশির মতো শোনায়। এতো শুকনো চিমশে যাওয়া মানুষ কেমন করে এরকম বিকটভাবে নাক ডাকতে পারে কে জানে!
নিতু সাবধানে হোস্টেল সুপারের ঘরের সামনে দাঁড়াল। একটা জানালা আধ খোলা, সেদিক দিয়ে ভেতরে বিছানাটা দেখা যাচ্ছে, মশারি টানানো, ভিতরে হোস্টেল সুপার ঘুমাচ্ছে। নিতু সাবধানে হাতের মুঠো থেকে ইঁদুরের বাচ্চাটা জানালায় ছেড়ে দিয়ে ফিস ফিস করের বলল, যা ব্যাটা, মজা দেখিয়ে দে।
নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটা জানালায় বসে একবার ইতিউতি তাকিয়ে হঠাৎ করে লাফ দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। নিতু সাথে সাথে নিশব্দে হেঁটে নিজের ঘরের ফিরে এল। মিতুল তখনো জেগে বসে আছে। নিতুকে দেখে ফিস ফিস করে বলল, কতক্ষণ লাগবে বলে তোর মনে হয়?
বেশিক্ষণ লাগার কথা না। নিতু চাপা গলায় বলল, হোস্টেল সুপারের ঘরটা একবার ঘুরে দেখে নিয়েই আমাদের ইঁদুর বাবাজী মশারির ভিতরে ঢুকে পড়বে!
কী হবে বলে তোর মনে হয়?
ঠিক কী হবে জানি না তবে বড় মজা হবে।।
নিতু আর মিতুল দুজনেই মুখে হাত চাপা দিয়ে এখন খিক খিক করে হাসতে থাকে।
দুজনে চুপ চাপ বসে মজার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু মজা আর শুরু হয় না। অপেক্ষা করে করে যখন তাদের মনে হতে থাকে নেংটি ইঁদুরের কোনো কারণে হোস্টেল সুপারকে অপছন্দ করে তার বিছানায় ঢুকতে চাইছে না ঠিক তখন হঠাৎ তারা একটি বিকট চিৎকার শুনতে পেল। মনে হল যেন ডাকাত পড়ছে—হোস্টেল সুপরি গলা ফাটিয়ে এমন ভয়ংকর আর্তনাদ করতে লাগল যে নিতু আর মিতুল পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। হোস্টেল সুপারের ঘরে দড়াম দড়াম করে শব্দ হতে লাগল, মনে হতে লাগল পুরো হোস্টেল বুঝি ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে।
নিতু আর মিতুল মুখে হাত দিয়ে খিক খিক করে হাসতে থাকে। ঘরের অন্যেরাও জেগে ওঠেছে আশে পাশের রুমে যারা আছে তাদের কেউ কেউ দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তখন নিতু আর মিতুলও দরজা খুলে বের হয়ে এল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা দেখতে পেল হঠাৎ করে হোস্টেল সুপারের দরজা খুলে গেল এবং ভিতর থেকে হোস্টেল সুপার গুলির মতো ছুটে বের হয়ে এল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকট অঙ্গভঙ্গি করে লাফাতে থাকে, দেখে মনে হয় কোনো একটা বিচিত্র কারণে হোস্টেল সুপার তার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলি খুলে ফেলতে চাইছে। শুধু তাই নয়, সেই বিকট নর্তন কুর্তনের সাথে সাথে হোস্টেল সুপার মুখ দিয়ে প্রচণ্ড জোরে চেঁচাতে শুরু করেছে।
মেয়েরা অবাক হয়ে হোস্টেল সুপারের কাছে হাজির হল, সবাই মিলে মোটামুটি গোল হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং মাঝখানে হোস্টেল সুপার তার বিকট ক্যারিকেচার করতে থাকল। ষাড়ের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে সে লাফাতে থাকে, দেখে মনে হয় তাকে কেউ গরম তাওয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। খানিকক্ষণ লাফাতে লাফাতে হঠাৎ হাত দিয়ে শরীরের বিচিত্র সব জায়গায় খামচাতে শুরু করে। মুখ বিকৃত করে বিকট শব্দ করতে করতে শরীরের কাপড় খুলতে শুরু করে এবং হঠাৎ করে থেমে গিয়ে শরীর ঝাকাতে ঝাকাতে ছোটাছুটি করতে থাকে দেখে মনে হয় অদৃশ্য কোনো ভূত বুঝি তাকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে।।
সবগুলি মেয়ে হতবাক হয়ে হোস্টেল সুপারের এই বিচিত্র নৃত্য দেখতে থাকে। হৈ চৈ গোলমাল শুনে জমিলার মাও চলে এসেছে, এমনিতে তার মুখে কোনো রকম অনুভূতির ছাপ পড়ে না কিন্তু এখন সেখানেও একটা অবাক হওয়ার ভাব। সে খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের গলায় ঝােলানো তাবিজটা হাত দিয়ে চেপে ধরে ফিস ফিস করে বলল, জীনের আছর।
কাসেম মেয়েদের মাঝে সবচেয়ে সাহসী, সে একটু এগিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, কী হয়েছে ম্যাডাম?
হোস্টেল সুপার তখন একটু শান্ত হয়েছে, কিন্তু ঠিক পুরোপুরি শান্ত হতে পারছে না, মাঝে মাঝেই কেমন যেন গা ঝাড়া দিয়ে শিউরে শিউরে উঠছে। শাড়ি প্রায় খুলে এসেছে, ব্লাউজের বোতাম খোলা, পাটের মতো চুল উশখুখুশকো, চোখে মুখে একটা অমানুষিক আতংক। কাসেম আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ম্যাডাম?
হোস্টেল সুপার মুখ হাঁ করে বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, ইঁদুর।
ইঁদুর? অনেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
হোস্টেল সুপার চোখ বড় বড় করে বলল, আমার পেটের ওপর দিয়ে এসে নাকের মাঝে ঢোকার চেষ্টা করেছে।