ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা
তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা
অঞ্চল সিঞ্চিত গৌরিক স্বর্ণে
গিরিমল্লিকা দুলে কুন্তল কর্ণে।
ঝাড়া মুখস্থ করা এই কবিতা বেচারা ফরহাদ বাসররাতের উত্তেজনায় পুরোপুরি ভুলে গেল। সে পুরো রাত কাটিয়ে দিল কবিতাটা মনে করার চেষ্টা করতে করতে। শীতের রাতেও তার কপাল দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়তে লাগল। তার স্ত্রী লজ্জা ভুলে গিয়ে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল, আপনার কি শরীর খারাপ?
আমি আর দশজন মানুষের মতো না। আমি যা ঠিক করি তা করি। বাসররাতে রূপাকে কী বলব সব আমি গুছিয়ে রাখলাম। তার রূপা নামটা পাল্টে দিতে হবে। রূপ থেকে রূপা। এই নাম চিৎকার করে বলে–আমি রূপবতী।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক উপন্যাসের নায়কের নাম যেমন ছিল ‘রাজকুমার’। নামটাই বলে দিচ্ছে মানুষটা অসম্ভব রূপবান। আপনি কি উপন্যাসটা পড়েছেন? উপন্যাসের নাম ‘চতুষ্কোণ’। এই একটি মাত্র উপন্যাস পড়েই কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার রাজকুমার হতে ইচ্ছা করেছিল। আপনি উপন্যাসটা না পড়ে থাকলে আপনাকে দিতে পারি। আপনি পুরোপুরি নিয়ে যেতে পারেন। আমার কাছে দু’টা কপি আছে। প্রথমটা হারিয়ে গেছে ভেবে আরেকটা কিনেছিলাম। কেনার পর পরই হারানো কপি ফিরে পেয়েছি। একই বইয়ের দু’টা কপি ঘরে রাখার কোনো মানে হয় না।
মূল গল্পে ফিরে যাই। রূপাকে কী বলব সব গুছিয়ে ফেললাম। প্রথমে নাম বদল, তারপর…
আমার বন্ধু ফরহাদের যেমন সব আউলে গিয়েছিল আমারও সে-রকম হলো। আমার আউলে গেল ভিন্ন কারণে। আমি দেখলাম রূপা কেমন করে যেন তাকাচ্ছে আমার দিকে। টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর শাঁ শাঁ শব্দ করছে। আমি বললাম, শব্দ কিসের?
সে বলল, আমার এলার্জির সমস্যা আছে।
আমি বললাম, এলার্জির সমস্যা থাকলে শাঁ শাঁ শব্দ হয়?
সে বলল, এলার্জির অ্যাটাক হলে শ্বাসনালি ফুলে যায়, তখন নিঃশ্বাসে কষ্ট হয় আর শাঁ শাঁ শব্দ হয়।
নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে?
হুঁ।
এর চিকিৎসা নেই?
ইনহেলার নিলে কমবে। আমি ইনহেলার আনতে ভুলে গেছি।
আমি আনিয়ে দিচ্ছি।
রহমত মিয়াকে ইনহেলার আনতে পাঠিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি রূপা স্বাভাবিক হয়েছে। সহজভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
আমি বললাম, ঘটনা কী? সেরে গেছে?
হুঁ।
আবার হবে?
জানি না।
গরম চা কিংবা কফি খাবে?
না।
আমি খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, তোমার রূপা। নামটা আমি বদলে দেব। এই নাম আমার পছন্দ না। নতুন নাম দেব।
কী নাম?
এখন থেকে তোমার নাম দস্তা।
কী নাম?
দস্তা। Zinc.
রূপা অবাক হয়ে বলল, দস্তা নাম কেন?
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, দস্তা আমার পছন্দের নাম। তাছাড়া একজন বিখ্যাত কবি তাঁর প্রেমিকাকে দস্তা-কন্যা সম্বোধন করেছেন।
দস্তা-কন্যা?
হ্যাঁ। আমেরিকান কবি। কবির নাম রবার্ট ফ্রস্ট। রবার্ট ফ্রস্টের নাম নিশ্চয়ই জানো। তুমি সাহিত্যের ছাত্রী।
রবার্ট ফ্রস্টের নাম জানি। কিন্তু তিনি তাঁর প্রেমিকাকে দস্তা-কন্যা ডাকতেন তা জানতাম না।
তিনি ডেকেছেন Zinc Lady নামে। আমি বঙ্গানুবাদ করলাম।
কবিতাটা কি আপনার মনে আছে? হ্যাঁ আছে। পুরোটা মনে নেই, কয়েক লাইন আছে—
Out of grave I come to tell you this,
Out of grave I come to quench the kiss
Oh my Zinc Lady.
দস্তা-কন্যা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। শা শাঁ শব্দ আবারো শোনা যাচ্ছে। আমি বললাম, পানি খাবে?
দস্তা-কন্যা ক্ষীণ স্বরে বলল, হ্যাঁ।
আমি বললাম, তুমি তো বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থ।
সে বলল, আমি সবসময় এরকম থাকি না। মাঝে মাঝে শরীর বেশি খারাপ করে।
তখন কী কর? শুয়ে থাক?
না, আধশোয়া হয়ে থাকি। আধশোয়া হয়ে থাকলে কষ্ট কম হয়।
তাহলে থাক আধশোয়া হয়ে।
দস্তা-কন্যা বাকি রাতটা খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে কাটিয়ে দিল। আমি এক ঘুম দিয়ে জেগে উঠে দেখি সে ঠিক আগের জায়গায় বসে আছে। শা শাঁ শব্দ হচ্ছে। তার চোখ চকচক করছে। মনে হয় একটু আগে কেঁদেছিল। এখন কান্না নেই কিন্তু কান্নার ছায়া চোখে লেগে আছে। দস্তা-কন্যার এই হতাশ ক্লান্ত রূপ দেখেই হয়তো আমি সেই রাতে তার প্রেমে পড়েছিলাম।
ভাই, আমি আমার প্রেমের গল্পটাই আসলে আপনাকে বলছি।
সবার প্রেম কি এক রকম হয়? একেকজনের প্রেম হয় একেক রকম। কেউ প্রেমে পড়লে প্রেমিকাকে নিয়ে পার্কে চলে যায়। এক ঠোঙা বাদাম কিনে। বাদাম ভেঙে ভেঙে প্রেমিকার হাতে তুলে দিয়ে গদগদ গলায় বলে, আজকে তোমাকে কী যে সুন্দর লাগছে!
আবার আরেক দল আছে…
আচ্ছা থাকুক, আমি প্রেম-শাস্ত্রের গবেষক না। আমি আমার নিজের প্রেমের গল্পটাই গুছিয়ে বলার চেষ্টা করি। তার আগে আমার অতি প্রিয় প্রেমের কবিতার কয়েকটা লাইন শুনবেন?
Love strong as death is dead
Come let us make his bed
Among the dying flowers;
A green turf at his head;
And a stone at his feet,
Whereon we may sit
In the quiet evening hours.
আজ থেকে দেড় শ’ বছর আগে ক্রিস্টিনা রোসেটি নামের এক তরুণী এই কবিতাটি লিখেছেন। আমি তার বঙ্গানুবাদ করেছি। ও আচ্ছা, আপনাকে বলা হয়। নি, আমার কবিতা-রোগ আছে। চার ছ’লাইনের কবিতা (কিংবা পদ্য) মাঝেমধ্যে লিখি। গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করে বানরগুলোকে শোনাই। এরা কবিতা পাঠের সময় ঝিম ধরে থাকে এবং অতি দ্রুত চোখ পিটপিট করতে থাকে। মজার ব্যাপার না?