ইফতেখার মামা মেয়ের বাবার দিকে ঝুঁকে এসে তার হাত ধরলেন। মেয়ের বাবা ইতস্তত করতে লাগলেন। ইফতেখার মামা বললেন, ভাইসাহেব, বলেন–হ্যাঁ কি না। একটা কিছু না বলা পর্যন্ত আমি হাত ছাড়ব না।
সোবাহান সাহেব (সাথীর বাবার নাম) আমতা আমতা করে বললেন, ছেলের চেহারা ছবি তো খুবই সুন্দর। আমার পছন্দটা তো বড় না, আমার মেয়ে…
ইফতেখার মামা বললেন, যান, মেয়ের মতামত নিয়ে আসুন। বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যার মতটাই গুরুত্বপূর্ণ।
চট করে সে কি কিছু বলবে? মিনিমাম সপ্তাহখানেক সময় তো দরকার।
ইফতেখার মামা বললেন, ভুল কথা বলেছেন ভাইসাহেব। এইসব কাজে সময় দিতে নাই। সময় দিলেই নানান হুজ্জত শুরু হয়। লাগানি ভাঙ্গানি চলতে থাকে। আপনি ভেতরে যান। মেয়ের মতামত নিয়ে আসেন।
সোবাহান সাহেব ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, মেয়ে। কিছু বলছে না। চুপ করে আছে।
ইফতেখার মামা বললেন, কান্নাকাটি কি করছে?
জি-না।
ইফতেখার মামা বললেন, তাহলে মেয়ের মত আছে। বাঙালি মেয়েকে। কখনো শুনছেন যে মুখ ফুটে বলবে বিয়েতে রাজি? রাজি না হলে বলবে–রাজি না। চোখের পানি ফেলবে। মেয়ে কাঁদছে না, কিছু বলছেও না–তার মানে আলহামদুলিল্লাহ। আসুন বিয়ে পড়িয়ে দেই।
সোবাহান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, বিয়ে পড়িয়ে দেবেন মানে কী?
ইফতেখার মামা হাসিমুখে বললেন, আপনাকে বলা হয় নাই, আমি একজন সরকারি কাজি। আমার কালো ব্যাগটার ভেতর কোরান শরিফ জায়নামাজ যেমন। আছে, কাবিননামার কাগজপত্রও আছে। সবসময় সঙ্গে রাখি। কখন কোন কাজে লাগে কে জানে। যান মেয়েকে অজু করতে বলেন। এজিন কাবিন হয়ে থাকুক। মেয়েকে তুলে নেয়া হবে পরে। তখন আমরা উৎসব করব।
সোবাহান সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, এইসব আপনি কী বলছেন?
ইফতেখার মামা মধুর হাসি হেসে বললেন, আজ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্র। অতি শুভ সময়। আল্লাহপাকের যদি হুকুম থাকে তাহলে আজই বিয়ে হবে। হুকুম না থাকলে কোনোদিন হবে না। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, রিজিক, ধনদৌলত–এই পাঁচ জিনিস আল্লাহপাক নিজের হাতে রেখেছেন। দেখি তাঁর মনে কী আছে।
সত্যি সত্যি সেই রাতেই বিয়ে হয়ে গেল। ইফতেখার মামা তার কালো ব্যাগ খুলে সবাইকে খোরমা খাওয়ালেন। খোরমা দেখে বুঝলাম তিনি মোটামুটি তৈরি হয়েই এসেছেন।
নাটক-নভেলে যেমন ঘটনা থাকে সে-রকম একটা ঘটনা ঘটল আমার বিয়ের রাতেই। আমি বাসায় চলে এসেছি। রাতে শোবার আয়োজন করেছি, এমন সময় আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে টেলিফোন। টেলিফোন করেছে আমার মেজ শালি। তার নাম রূপা। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমাদের বাড়িতে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে।
আমি বললাম, কী ঘটনা ঘটেছে?
বড় আপা খুব কান্নাকাটি করছে।
আমি বললাম, বিয়ের পর মেয়েরা কান্নাকাটি করেই থাকে।
রূপা বলল, আপনি বুঝতে পারছেন না। বড় আপা শুধু যে কান্নাকাটি করছে তা-না, সে ঘনঘন ফিটও হচ্ছে।
আমি বললাম, ফিট হচ্ছে কেন? তার কি মৃগীরোগ আছে?
রূপা বলল, মৃগীরোগ নেই। আপা হুট করে পড়ানো বিয়ে মানতে পারছে। সে বলছে এই বিয়ে যদি না ভাঙা হয় তাহলে সে হয় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে। নিচে পড়বে আর না হয় ঘুমের ওষুধ খাবে।
তুমি তোমার আপাকে দাও, আমি কথা বলি।
আচ্ছা আপনি ধরুন, আমি আপাকে দিচ্ছি।
আমি প্রায় পনেরো মিনিট টেলিফোন কানে ধরে বসে রইলাম। পনেরো মিনিট পর রূপা এসে বলল, আপা আপনার সঙ্গে কথা বলতে রাজি না। সে দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে।
বলো কী?
আমি আপনার পায়ে পড়ছি–আপনি বিয়ে ভাঙার একটা ব্যবস্থা করুন। আপা খুবই ইমোশনাল একটা মেয়ে। বিয়ে না ভাঙলে আপাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
আমি শান্ত গলায় বললাম, তুমি তোমার আপাকে বলো–আগামীকাল সকাল দশটার দিকে আমি ইফতেখার মামাকে নিয়ে আসব, বিয়ে ভাঙাতে হলে যা যা করণীয় তখন তা করা হবে। আমি রাতেই আসতাম, কিন্তু এত রাতে মামাকে পাওয়া যাবে না। মামা রাত বারটার পর থেকে তাহাজ্জুতের নামাজে দাঁড়ান। তখন তাঁকে ডাকা নিষেধ।
আপনি কি সত্যি সত্যি কাল সকালে আসবেন?
অবশ্যই আসব। দশটার মধ্যেই আসব।
থ্যাংক য়্যু।
থ্যাংকস দিতে হবে না। তুমি তোমার আপাকে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে যেতে বলো।
পরদিন তালাকের ব্যবস্থা হলো। আমি তালাকপর্বের পর হাসিমুখেই কিছুক্ষণ ঐ বাড়িতে থাকলাম। চানাচুর এবং ঘরে বানানো পায়েস খেলাম। সোবাহান সাহেবের সঙ্গে দেশের রাজনীতি নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তিনি তার গ্রামের বাড়িতে তার দাদার হাতে লাগানো একটা পেয়ারা গাছের গল্প করলেন। সেই পেয়ারা নাকি এই ভুবনের সেরা। একবার যে ঐ পেয়ারা খেয়েছে। সে বাকি জীবনে আর পেয়ারা মুখে দিতে পারবে না। পেয়ারা মুখে দিলেই থু করে ফেলে দেবে। আমি পেয়ারার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখালাম। তিনি বললেন, ওই পেয়ারা এনে তিনি আমাকে খাওয়াবেন।
আষাঢ় মাসে তিনি সত্যি সত্যি পেয়ারা এনে আমাকে খাওয়ালেন এবং শ্রাবণ মাসে তার মেজ মেয়ে রূপার সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। তাড়াহুড়া বিয়ে না। আয়োজনের বিয়ে। গায়ে-হলুদ ফলুদ সবই হলো। বরের জুতা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া থেকে আয়নায় বর-কনের মুখ দেখাদেখি কিছুই বাদ গেল না। রূপার বড় বোন খুবই আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানে যোগ দিল।
বাসররাতে স্ত্রীকে কী কী কথা বলবে
আমার ধারণা বাসররাতে স্ত্রীকে কী কী কথা বলবে সব ছেলেই তা ঠিক করে রাখে। কয়েকবার রিহার্সেলও দেয়। মূল সময়ে সব গুবলেট করে ফেলে। আমার বন্ধু ফরহাদ বাসররাতে স্ত্রীকে শুনিয়ে মুগ্ধ করার জন্যে একটি দীর্ঘ কবিতা মুখস্থ করে রেখেছিল। তার স্ত্রীর নাম ঝরনা। সে মুখস্থ করেছিল সত্যেন্দ্রনাথের ঝর্ণা কবিতাটি। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন, ঐ যে—