রফিক আবারো বলল, জলিল সাবরে খবর দেই?
আমি বললাম, খবর দিতে হবে না। আমি ভালো আছি। রফিক শোন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করব।
রফিক চমকে উঠল। সম্ভবত কিছুক্ষণ ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারল না। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হড়বড় করে বলল, ইফতেখার সাবরে খবর দেই?
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, দাও।
আমার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে লোকজন আছে। তাদের দায়িত্ব ভাগ করা। চিকিৎসাসংক্রান্ত কাজের জন্যে আছেন জলিল চাচা। পারিবারিক কর্মকাণ্ডের জন্যে আছেন শেখ ইফতেখার। সম্পর্কে মামা। আমার মায়ের খালাতো ভাই। বৈষয়িক কর্মকাণ্ডের জন্যে আছেন রহমত মিয়া। অতি অতি ধুরন্ধর লোক। দিনকে রাত করা তার কাছে ছেলেখেলা। তার কর্মপদ্ধতি যথেষ্ট জটিল। তিনি যে ফিলসফিতে বিশ্বাস করেন সেটা–অনুরোধে কাজ করব না। করাব না। ধরাধরিতেও কাজ করাব না। টাকা দিয়ে কাজ করাব। হাসিমুখে কাজ করবে, সময়মতো করবে, দেখা হলে কুকুরের মতো আনন্দে লেজ নাড়বে। মানুষ যখন আনন্দে তার অদৃশ্য লেজ নাড়ায় তখন দেখতে বড় মজা লাগে।
রহমত মিয়া মাসে একবার গাড়ি নিয়ে ভৈরব চলে যান। গাড়ি ভর্তি করে। বিশাল বিশাল মাছ নিয়ে ফেরেন। সেইসব মাছ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের বাড়িতে উপহার হিসেবে চলে যায়। রহমত মিয়া মাথা নিচু করে বলেন, বুঝলেন ভাইজান, পাঁচ হাজার টাকার একটা মাছে যে কাজ করবে পঞ্চাশ হাজার টাকা। ঘুসে সেই কাজ হবে না। দু’শটা এক বিঘৎ সাইজের কৈ মাছ দিয়ে আমি একবার দশ লাখ টাকার কাজ করিয়ে নিয়েছিলাম।
মানুষকে ঘুস দেয়া বিরাট শিল্পকর্ম। রহমত মিয়া সেই শিল্পকর্মের একজন বিপুল কারিগর। তার কথা পরে বলব, এখন ইফতেখার মামার প্রসঙ্গে আসি। বৈষয়িক লাইনে যেমন রহমত মিয়া, পারিবারিক লাইনে তেমনি ইফতেখার মামা। বিশাল কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় রুমী টুপি (এই জিনিস নাটক-সিনেমা ছাড়া আজকাল দেখি না, কিন্তু মামার কাছে আছে)। ইফতেখার মামার সঙ্গে ব্রিফকেস জাতীয় একটা ব্যাগ সবসময় থাকে। ব্যাগের ভেতর থাকে একটা জায়নামাজ, তসবি, একটা কোরান শরিফ এবং এক বোতল জমজমের পানি। কথাবার্তার এক ফাকে যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে তখন তিনি অবধারিতভাবে গম্ভীর গলায় বলেন, একটু অজুর পানি দিতে হয় যে, নামাজ পড়ব। কেবলা কোন দিকে?
তিনি অনেক সময় নিয়ে নামাজ পড়েন। তসবি পাঠ করেন। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় মোনাজাত করেন। নামাজ এবং মোনাজাতপর্ব শেষ হবার পর তিনি সবাইকে এক ঢোক করে জমজমের পানি খেতে দেন। সেই পানি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কেবলামুখি হয়ে (নামাজের ভঙ্গিতে বসে) খেতে হয়।
ইফতেখার মামার বোতলের জমজমের পানি কখনো শেষ হয় না। বোতল অর্ধেক খালি হতেই তিনি তার সঙ্গে মিনারেল ওয়াটার যুক্ত করেন। তিনি বিশিষ্ট আলেমদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন এতে জমজমের পানির গুণাগুণের কোনো তারতম্য হয় না।
তিনি যখন নতুন কারো সঙ্গে কথা বলেন তখন কথাবার্তার একটা পর্যায়ে বলেন–বুঝলেন জনাব, আমি অতি ক্ষুদ্র নাদান মানুষ। গুনার মধ্যে ড়ুবে আছি। মৃত্যুর পরে আল্লাহ আমাকে কী আজাব দিবেন সেই চিন্তায় অস্থির থাকি। রাতে ঘুম হয় না। গেলাম একবার হজ করতে। সেখানে কাবা শরিফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কিছু পারি না-পারি, নবিজির একটা সুন্নত বাকি জীবন পালন করব। মিথ্যা কথা বলব না। ঝোকের মাথায় প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলাম, তারপরে যে বিপদে পড়েছি সেই বিপদের কোনো মা-বাপ নাই। মনের ভুলে যদি ফুট ফাট এক আধটা মিথ্যা বলে ফেলি, সাথে সাথে যে হাতে কাবা ছুঁয়ে ছিলাম সেই হাত অবশ হয়ে যায়। তওবা না করা পর্যন্ত হাত ঠিক হয় না। আমি কী যে মুসিবতের মধ্যে আছি সেটা আর আপনাদের কী বলব, আমার মতো বিপদে যেন কেউ না পড়ে।
এই ধরনের মানুষ অতি দ্রুত যে-কোনো পরিবেশে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ইফতেখার মামা এই কাজটি করেন।
ভাই, আপনি কী বললেন? কাবা শরিফ ছুঁয়ে সত্যি সত্যি তিনি কোনো প্রতিজ্ঞা করেছেন কি-না? আমি বলতে পারি না। তাকে কখনো জিজ্ঞেস করি নি। তবে তিনি যে সত্যি কথা বলেন এটা ঠিক।
ইফতেখার মামা অতি দ্রুত আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। মেয়ের নাম সাথী। সে ডাক্তার।
চমকে উঠলেন, না? আগে আপনাকে বলেছিলাম মেয়ের নাম রূপা। মেয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। মেয়ের বড় বোন ডাক্তার, তার নাম সাথী। এই কারণেই শুরুতে আপনাকে আমার স্ত্রীর কী নাম সেটা বলতে চাচ্ছিলাম না। এখন ঘটনা বলব, আপনার কাছে সব পরিষ্কার হবে।
ইফতেখার মামা হলেন ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ টাইপ মানুষ। বিয়ের কথা শুরু হবার এক সপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়ে হয়ে গেল। সেই বিয়েও বিচিত্র। আমি গিয়েছি মেয়ে দেখতে। খানিকটা প্রাচীন কায়দায় মেয়ে দেখা হচ্ছে। আমি বসে আছি তাদের বাড়ির বসার ঘরে। আমার সঙ্গে আছেন ইফতেখার মামা, ডাক্তার জলিল চাচা এবং রহমত মিয়া। ডাক্তার কন্যা জড়সড় ভঙ্গিতে ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ঢুকল। ভীত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে অতি দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।
জলিল চাচা বললেন, মাশাল্লা, মেয়ে তো অত্যন্ত রূপবতী।
ইফতেখার মামা বললেন, মেয়ে দেখার কিছু নাই। আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছি মেয়ে আমাদের পছন্দ। আজ আমরা ছেলে নিয়ে এসেছি। ভালো করে। ছেলে দেখেন। ছেলেকে যদি জিজ্ঞাসা করার কিছু থাকে জিজ্ঞেস করেন। আড়ালে কথা বলাবলির কিছু নাই। পছন্দ না হলে মুখের উপর বলবেন, পছন্দ হয় নাই। আর পছন্দ হলেও মুখের উপর বলবেন, পছন্দ হয়েছে।