ঠিক আছে, ভূত দিয়েই শুরু করি। যদিও ভূতের গল্পটা এখন করতে চাচ্ছিলাম না। ভূতের গল্প যত ভয়ঙ্করই হোক, দিনের বেলা পানসে লাগে। শুধু পানসে না, হাস্যকরও লাগে। যিনি দিনের বেলায় আগ্রহ নিয়ে ভূতের গল্প করেন, সবাই তার দিকে মজা পাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন সে ভূতের গল্প বলছে। না, জোকস বলছে। খুব সিরিয়াস জায়গায় নিজেকে অতিরিক্ত বুদ্ধিমান মনে করেন, এমন শ্রোতা সবাইকে হাসানোর জন্যে বলে বসেন–তারপর ভূতটা কী করল? আপনার সঙ্গে কোলাকুলি করল? যিনি ভূতের গল্প করছেন তিনি তখন রেগে যান। তিনি যতই রাগেন অন্যরা ততই মজা পায়। এই মজাটা আমি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম না।
যাই হোক, ভূত প্রসঙ্গটা দ্রুত শেষ করে বিয়ের প্রসঙ্গে আসি। এক শ্রাবণ মাসের ঘোর বর্ষার দুপুরে আমি ভূত দেখলাম। সরি, একটু ভুল হয়েছে–ভূতের কথা শুনলাম। ঘটনাটা বলি। দুপুরের খাওয়া শেষ করে বই হাতে নিয়ে বিছানায় গিয়েছি। সরি, আবারো ভুল করেছি। বই না, ম্যাগাজিন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। দুপুরের খাবার পর আমি ম্যাগাজিন পড়ি। রাতে পড়ি বই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে তুন্দ্রা অঞ্চলে বিপন্ন পেঙ্গুইনদের উপর একটা লেখা পড়ছি। সুন্দর সুন্দর ছবি। ছবিগুলি দেখতে ভালো লাগছে। খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। বিছানায় চাদর নেই বলে গায়ে চাদর দিতে পারছি না। চাদর বের করে দেবার জন্যে কাউকে ডাকতে হবে। বিছানায় শুয়ে ডাকলে হবে না, আমাকে দোতলা থেকে একতলায় নামতে হবে। কারণ আমার কোনো কাজের লোকের দোতলায় উঠার হুকুম নেই। দোতলাটা আমার একার।
যে চাদরের উপর শুয়ে আছি তারি অর্ধেকটা নিজের উপর দিয়ে পড়তে শুরু করলাম। আর্টিকেলের শুরুটা করেছে চমৎকার। জন স্টেইনবেকের উপন্যাসের নাম দিয়ে প্রবন্ধের শুরু–It was a winter of discontent.
বাক্যটা শেষ করা মাত্র পরিষ্কার মেয়েলি গলায় একজন কেউ বলল, কী পড়েন?
আমি বই নামিয়ে বললাম, কে?
তার উত্তরে নারীকণ্ঠ সামান্য হেসে আবারো বলল, কী পড়েন?
এর মধ্যে আমি দেখে নিয়েছি যে ঘরে কেউ নেই। ভয় পাই নি খুবই বিস্মিত হয়েছি। তবে অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কে কথা বলে?
এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ একজন হালকা করে নিঃশ্বাস ফেলল। জবাব দিল। আমি দীর্ঘ রচনাটা পড়ে শেষ করলাম। কোনো কথাবার্তা শুনলাম না। পর পর দু’টা সিগারেট টেনে ঘুমুতে গেলাম। ভালো ঘুম হলো। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস। বাতাসে জানালা নড়ছে। খটখট শব্দ হচ্ছে। খুবই বিরক্তি লাগছে। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঘুমটা পুরোপুরি কাটে নি। আরো কিছুক্ষণ ঘুমানো যায়। এই সময় দুপুরের নারীকণ্ঠ আবার শুনলাম। সে মধুর গলায় বলল, আর কত শুয়ে থাকবেন?
দুপুরের নারীকণ্ঠের কথা কিছুই মনে ছিল না। হঠাৎ সবটা এক সঙ্গে মনে পড়ল। আমি হতভম্ব গলায় বললাম, একী! বিছানা থেকে নামলাম। হাত-মুখ ধুলাম। এবং খুবই স্বাভাবিকভাবে এক তলায় চলে গেলাম। রফিক সঙ্গে সঙ্গে মগভর্তি চা নিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, স্যারের কি শরীর খারাপ? আমি বললাম, না, শরীর ঠিক আছে। তার চোখ থেকে উদ্বিগ্ন ভাব দূর হলো না। রফিক আমার সঙ্গে আছে প্রায় বার বছর। বার বছর দু’জন মানুষ পাশাপাশি থাকলেই একজন আরেকজনের জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করে। এটা জগতের অনেক গুরুত্বহীন সাধারণ নিয়মের একটি। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, রফিক, আমাদের বাড়িতে কি ভূত আছে?
রফিক সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি স্যার আছে।
তুমি কখনো দেখেছ?
জি।
ভূতটা কী করে?
কিছু করে না। হাসে কান্দে। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। মসলা পিষে।
মসলা পিষবে কেন? ভূতের কি রান্নাবান্না করার কোনো ব্যাপার আছে?
রফিক জবাব দিল না। ভীত মুখ করে দাড়িয়ে রইল। আমি চিন্তিত বোধ করলাম না, কারণ চিন্তিত বোধ করার কিছু নেই। আমার যা হচ্ছে তার নাম। হেলুসিনেশন। অডিটরি হেলুসিনেশন। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের এরকম হয়। খুব সম্ভব আমি সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আমি সম্ভবত নিউরোসিস পর্যায়ে আছি। রোগ বাড়তে দিলে সাইকোসিস পর্যায়ে চলে যাব। তখন আর কিছু করার থাকবে না। সাইকোসিস পর্যায়ে ভয়ঙ্কর কাণ্ডকারখানা ঘটতে থাকবে। তার আগেই কোনো একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত। নিওরোসিস এমন কোনো ব্যাপার না। পৃথিবীর বিশ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে নিওরোসিসের রোগী। এই রোগ মাথায় নিয়ে বাস করা যায়। বারমেসে সর্দির মতো বারমেসে হালকা নিওরোসিস।
এই মুহূর্তে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে ছুটে যাবার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। নিজের চিকিৎসা আমাকে নিজেকেই করতে হবে। দোতলায় বাস করতে পারবে। এমন কাউকে আমার প্রয়োজন। বইপত্রে যতদূর পড়েছি অডিটরি হেলুসিনেশনের ব্যাপারগুলি একা থাকলেই হয়।
আমি দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিলাম। রফিক ভয়ে ভয়ে বলল, জলিল সাবরে খবর দিব?
আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম। জলিল সাহেব (মোঃ আবদুল জলিল) আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। বয়সজনিত কারণে এখন রোগী দেখা বন্ধ। করেছেন, তবে আমার চিকিৎসা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। খবর পেলেই তাঁর মরিস মাইনর গাড়ি নিয়ে ছুটে আসেন। তাঁর সমস্যা একটাই, ছোট কোনো অসুখ তিনি চিন্তা করতে পারেন না। যদি তাকে বলা হয় মাথাব্যথা। তিনি তৎক্ষণাৎ বলেন–ঘনঘন মাথাব্যথা? বলে কী! মাথায় কোনো টিউমার হয় নি। তো? বাবা, চোখে কি ঝাপসা দেখ? যদি বলি–ডান পাটা কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলায় বলেন–পা ফোলা তো ভালো কথা না। কিডনি ফেল করে নি তো? আজকাল ঘরে ঘরে কিডনি ফেল করা রোগী।