এমন কোনো ওষুধ কি আছে যা খেলে গাছ ঘুমিয়ে পড়ে? গাছ যে ঘুমায় তা আমরা জানি। কিছু কিছু গাছ যেমন তেঁতুল সন্ধ্যাবেলায় পাতা বন্ধ করে দেয়। আমি জানতে চাচ্ছি এমন কোনো ওষুধ কি আছে যা খেলে দিনেদুপুরে গাছ ঘুমিয়ে পড়বে?
এইটাই আপনার প্রশ্ন?
জি।
এই প্রশ্ন করার জন্যে রাত দু’টার সময় টেলিফোন করেছেন?
জি।
আমি এই প্রশ্নের জবাব জানি না।
বলেই ভদ্রলোক টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন।
আমি রাত সাড়ে তিনটার দিকে আবার টেলিফোন করলাম। আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোক টেলিফোন ধরবেন না। মোবাইলে আমার নাম্বার দেখেই সাবধান হয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি ধরলেন। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ভাই, ভালো আছেন?
তিনি জড়ানো গলায় বললেন, কে?
আমার নাম ফখরুদ্দিন। রূপার সঙ্গে সন্ধ্যায় আপনার বাসায় গিয়েছিলাম।
কী ব্যাপার?
একটা প্রশ্ন ছিল।
আপনি দয়া করে ঘুমুতে যান।
প্রশ্নটার উত্তর জানার জন্যে মনের ভেতর খুঁতখুঁতানি তৈরি হয়েছে। ওটা দূর। হলে ঘুম আসবে না।
কী প্রশ্ন বলুন।
গাছ-বিষয়ক একটা প্রশ্ন। গাছের জীবন আছে এটা তো আমরা জানি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন পাগল হয়ে যায়, গাছের বেলায় কি সে-রকম হতে পারে? আমবাগানের একটা আম গাছ পাগল হয়ে গেল–এরকম। দশটা আম গাছ ভালো, একটা আম গাছ বদ্ধ উন্মাদ। কিংবা আপনাদের পরিভাষায় মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত।
ভদ্রলোক টেলিফোন অফ করে দিলেন। রাত চারটার দিকে আবার করলাম, তখনো টেলিফোন অফ। ভোর পাঁচটায় করলাম, তখনো অফ। রবার্ট ব্রুসের মতো অসীম ধৈর্যে আমি টেলিফোন করেই যেতে থাকলাম। এক সময় না এক সময় তিনি তার মোবাইল অন করবেন, তখন যেন তার সঙ্গে কথা বলা যায়।
সকাল সাড়ে নটায় তিনি টেলিফোন ধরলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, কে?
আমি বললাম, ভাই, আমার নাম ফখরুদ্দিন চৌধুরী। রূপাকে নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায়…
বাক্য শেষ করার আগেই ভদ্রলোক টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন। সারাদিনে তিনি আর টেলিফোন চালু করলেন না। আমি অবশ্যি সারাদিনই চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। কর্মহীন মানুষদের ধৈর্য ভালো হয়। যে-কোনো তুচ্ছ কাজে তারা লেগে থাকতে পারে। এরা খুব ভালো বর্শেল হয়। ছিপ ফেলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে পারে। পুকুরে মাছের ঘাই শুনে বলে দিতে পারে–কী মাছ, কত বড় মাছ।
কর্মহীন মানুষ বার্ডওয়াচার হয়। দুরবিন হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। মা-পাখি শিশুদের খাওয়াচ্ছে। দিনে ক’বার খাওয়াচ্ছে, কী খাওয়াচ্ছে সব তারা জানে। তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন, বলুন তো দেখি, একশ্রেণীর বক আছে যাদের থুতনিতে ছাগলের দাড়ির মতো দাড়ি। দাড়িওয়ালা বকদের নাম কী? তারা সঙ্গে সঙ্গে বলবে নাম–মেছো বক।
এরা আমার মতো বইপড়া জ্ঞানী হয়। রাজ্যের বই পড়ে পড়ে মাথার স্মৃতিকোষ অর্থহীন জ্ঞানে বোঝাই করে রাখে। কেউ দর্শনের বই পড়ে পড়ে হয়। দার্শনিক। কেউ গাছপালার বই পড়ে পড়ে শখের বোটানিস্ট। ইউনিভার্সিটির পাস করা বোটানিস্টকে যদি জিজ্ঞেস করেন–আচ্ছা স্যার, ভুইআমলা গাছের নাম জানেন? তাঁরা ভুরু কুঁচকে বলবেন–ভুইআমলা? দেশী গাছ? সাইন্টিফিক নাম কী বলুন তো?
একজন শখের স্বশিক্ষিত বোটানিস্টকে জিজ্ঞেস করুন; তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে বলবেন- ও আচ্ছা, ভূমিআমলা–ভূমি আমলকির কথা বলছেন? কেউ কেউ আবার একে বলেন ভুধাত্রী। অন্য আরেকটা নাম আছে–তমালিকা। Euphorbiaceae পরিবারের গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Phyllanthus freteratus. কেন চিনব না?
অনেক কথা বলে ফেলেছি
আপনাকে অনেক কথা বলে ফেলেছি। এখন আপনার কী ধারণা হচ্ছে? আমি পাগল? না-কি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পছন্দ করে এমন কেউ?
পাগলরাও কিন্তু মানুষকে বিভ্রান্ত করে মজা পায়। তারা নিজেরা বিভ্রান্ত বলেই অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করতে চায়। আমার এক বন্ধু ইসলামিয়া কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। একদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনি ইজিচেয়ারে বসে পান খাচ্ছেন। আমাকে দেখেই মোটামুটি আনন্দিত গলায় বললেন, খবর শুনেছ? আমি
তো পাগল হয়ে গেছি। ব্রেইন পুরোপুরি কলাপস করেছে।
আমি বললাম, তাই নাকি!
তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, হ্যাঁ ঘটনা সে-রকম। আমার ফ্যামিলির লোকজন অবশ্যি আসল কথা ফাঁস করছে না। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে আমার সামান্য মাথা গরম হয়েছে। আমি তো জানি ঘটনা কী।
ঘটনা কী?
ঐ যে বললাম, পাগল হয়ে গেছি। লক্ষণ কী জানতে চাও?
জানতে চাই।
ঘটনা হলো–সারাক্ষণ আমার পেটে কে যেন কথা বলে। অর্ধেক বোঝা যায়, অর্ধেক যায় না। আমার পেটে কান রাখলে তুমিও শুনতে পাবে। এসো, শুনে দেখ।
বলেই তিনি পাঞ্জাবি উপরে তুলে পেট বের করলেন। তিনি যা করলেন তা হলো–আমাকে বিভ্রান্ত করলেন। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার মনে হলো–সত্যি সত্যি কেউ বোধহয় তার পেটে কথা বলছে।
রূপার সঙ্গে কীভাবে আমার বিয়ে হলো সেই গল্প শুনবেন, না-কি আমার বাড়িতে ভূতের উপদ্রবের গল্পটা শুনবেন? আমি দুটাই বলব। কোনটা আগে শুনতে চান? ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে ভূতেরটা আগে বলতে হয়, তবে ইন্টারেস্টিং বেশি বিয়েরটা। ভূত এবং বিয়ে আমার বেলায় সম্পর্কিত। ফিজিক্সে প্রথমে Cause তারপর Effect. আমার বেলায় ভূতটা Cause, বিয়ে হলো Effect.