তা ঠিক। অবশ্যই ঠিক–তবে জানো কি বাবা, বাইরে ঘোরাঘুরি করলে শারীরিক পরিশ্রম হয়, তাতে রাতে সুন্দ্রিা হয়। সুন্দ্রিা আমাদের জন্যে প্রয়োজন।
আমার দ্রিা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, আমার সুদ্রিা হয়।
রূপা বলছিল রাতে তুমি ছাদে বসে থাক।
ঠিক বলে নি। রাতে ছাদে অল্প কিছু সময় কাটাই। তাও বসে থাকি না। শুয়ে থাকি।
কেন?
এমনি। কোনো কারণ নেই।
রূপা বলছিল তুমি না-কি বাঁদরের সঙ্গে কথা বলো।
মাঝে মাঝে বলি।
কী কথা বলো?
নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলি না। যখন যা মনে আসে বলি।
ও আচ্ছা।
আপনি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?
না।
আমার শ্বশুরসাহেব পুরোপুরি ঝিম মেরে গেলেন। তাঁর ঝিমন্ত ভাব আরো বাড়াবার জন্যে বললাম, শ্রোতা হিসেবে বাদর খুব ভালো।
শ্বশুরসাহেব বিড়বিড় করে বললেন, তাই না-কি?
আমি বললাম, জি। এরা খুব মন দিয়ে কথা শোনে।
শ্বশুরসাহেব ঝিম ধরা গলায় বললেন, ও আচ্ছা। ভালো।
কর্মহীন মানুষ নিজেদের ব্যস্ত রাখার জন্যে নানান ধরনের কাজ খুঁজে বের করে। আমার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে আমি অনেক কিছুই করতাম। বাঁদরের সঙ্গে গল্প করার কথা তো আগেই বলেছি। আমার অফুরন্ত অবসরের একটা বড় অংশ বই পড়ে কাটত। তার পরেও হাতে প্রচুর সময়। এই সময়টা একেক সময় একেক কাজে লাগাতাম। বাইরের মানুষের। কাছে এই কাজগুলিকে পাগলামি মনে হতে পারে। রূপার তাই মনে হতো। হয়তোবা আপনারও তা মনে হবে। একটা উদাহরণ দেই–একবার বইয়ে। পড়লাম ইউপাস ট্রির কথা। অতি বিষাক্ত গাছ। মাত্র আড়াই ফুট লম্বা হয়। পাওয়া যায় জাভা দ্বীপে। গাছগুলি এতই বিষাক্ত যে এ গাছ যেখানে জন্মায় তার আশপাশের দু’মাইলের ভেতর কোনো বড় গাছ তো দূরের কথা, ঘাসও জন্মাতে পারে না। জীবজন্তু, পশুপাখি কেউ এর ধারে কাছে আসতে পারে না। বিষের জ্বালায় মৃত্যুবরণ করে। এই গাছের চারপাশ ধুধু মরুভূমি হয়ে যায়।
আমার মাথায় খেয়াল চাপল এরকম গাছ একটা পাওয়া গেলে কেমন হয়! খোঁজ-খবর করে জানলাম সেটা সম্ভব নয়। ভাবলাম পরিচিত কোনো গাছকে বিষাক্ত করা যায় না? কিছুদিন সেই চেষ্টা চলল, নানান জাতের বিষ এনে পানিতে গুলে টবে রাখা গাছে দিয়ে দি। দিন চারেকের মধ্যে গাছগুলি মরে যায়। মানুষের জন্যে ক্ষতিকর বিষ দেখা গেল গাছের জন্যেও ক্ষতিকর। সেখান থেকে মাথায় চিন্তা এলো–গাছকে পানির বদলে মানুষের রক্ত দিলে কেমন হয়? এতে গাছের কি কোনো পরিবর্তন হবে? যদি হয় তাহলে কী জাতীয় পরিবর্তন হবে? সমস্যাটা নিয়ে বেশ কিছু দিন ভাবলাম। দেখা গেল মানুষের রক্ত দেয়ার কিছু সমস্যা আছে। প্রধান সমস্যা, রক্ত জমাট বেঁধে যায়। জমাট বাঁধা রক্ত পানির মতো মাটির ভেতর যেতে পারে না। দ্বিতীয় সমস্যা, রক্ত পাব কোথায়? দু’টি সমস্যারই সুন্দর সমাধান বের করলাম। ব্ল্যাডব্যাংকের রক্ত। টাকা দিয়ে কিনলেই হয়। এই রক্ত প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা থাকে। এন্টিকোয়াগুলেন্ট দেয়া থাকে বলে রক্ত জমাট বাঁধে না। টাকা এবং যোগাযোগ থাকলেই এই রক্ত পাওয়া কোনো সমস্যা নয়। দুটোই আমার আছে।
রক্তের এক লিটারের দশটি ব্যাগ কিনে আনলাম। টবে পোতা একটা। পেয়ারা গাছের গোড়ায় রোজ এক লিটার করে বি পজিটিভ রক্ত দেই। তৃতীয়। দিনের দিন রূপা জিজ্ঞেস করল, এইসব কী?
আমি বললাম, রক্ত। মানুষের রক্ত।
রূপা হতভম্ব গলায় বলল, রক্ত গাছে দিচ্ছ কেন?
দেখছি–গাছের কোনো পরিবর্তন হয় কি-না।
রূপার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, তুমি অসুস্থ। তুমি অসুস্থ।
আমি মোটেই অসুস্থ না। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ।
রূপা বলল, তুমি ভয়ঙ্কর অসুস্থ। এবং তুমি তা জানো না।
আমি রূপাকে কিছুতেই বুঝতে পারলাম না যে আমি মোটেই অসুস্থ নই। মানুষ হিসেবে আমি বুদ্ধিমান এবং দয়ালু।
রূপা বলল, আমার মনে হয় না, আমি তোমার সঙ্গে বাস করতে পারব।
আমি বললাম, তুমি অবশ্যই আমার সঙ্গে বাস করতে পারবে। তোমার কোনো সমস্যাই হবে না।
এই পরীক্ষা যদি বন্ধ না কর, আমি থাকব না।
আমি পরীক্ষা বন্ধ করে দিলাম। রূপা চলে যাবে এই ভয়ে যে বন্ধ করলাম তা না। পঞ্চম দিনের দিন গাছটা মরে গেল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, গাছটা চতুর্থ দিনে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল–পাতাগুলি হয়েছিল নীলচে এবং কাণ্ডটা হয়ে গেল ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের। রক্তের কারণে যে গাছ মরে গেছে তা কিন্তু না। বরং গাছটাকে অনেক বেশি সজীব লাগছিল। গাছটা মারা গেল পিঁপড়ার আক্রমণে। রক্তের লোভে ঝাকে ঝাকে পিঁপড়া এসে গাছটাকে আক্রমণ করল। গাছের শিকড় কেটে লণ্ডভণ্ড করে দিল।
আমি ঠিক করলাম এই পরীক্ষাটা আমি আবার করব। এইবার করব এমনভাবে যেন পিপড়া গাছ আক্রমণ করতে না পারে। টমেটো গাছ নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। কনট্রোলড এক্সপেরিমেন্ট। আটটা গাছ থাকবে। চারটায় পানির বদলে রক্ত দেয়া হবে। চারটায় পানি। টমেটো হবার পর খেয়ে দেখা হবে–টমেটোর স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি-না।
গাছের পরীক্ষার পর পর রূপা আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেল, যে কথা আপনাকে শুরুতে বলেছি। ভদ্রলোক নানান প্রশ্ন-ট্রশ্ন করলেন। খুব চালাকি ধরনের প্রশ্ন, যাতে আমি বুঝতে না পারি ব্যাপারটা কী। আমি প্রতিটি প্রশ্নের এমন জবাব দিলাম যে ভদ্রলোক মোটামুটি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। ভদ্রলোকের প্রশ্নের এবং আমার উত্তরের কিছু নমুনা দেই।