বাহ অদ্ভুত তো!
যে নক্ষত্ররাজি যতদূরে সে তত বেশি গতিতে বাইরের দিকে ছুটছে।
কোথায় যাচ্ছে?
কোথায় যাচ্ছে আমরা জানি না। তবে একটা জিনিস জানি–সবচে’ দূরবর্তী নক্ষত্ররাজি ছুটছে আলোর গতিতে। তাতে একটা বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
কী সমস্যা?
যে বস্তু আলোর গতিতে ছুটে তার কাছে সময় বলে কিছু নেই। ঐসব বস্তু বাস করছে সময় শূন্য জগতে। কাজেই ঐসব বস্তু সম্পর্কে আমরা কোনোদিনই কোনো কিছু জানতে পারব না।
আমি গল্প করছি। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে গল্প শুনছে কাঁসা-কন্যা। আহারে, কী আনন্দময় সময়!
মূল গল্প থেকে একটু সরে যাই
মূল গল্প থেকে একটু সরে যাই? তাতে আপনার নিশ্চয়ই সমস্যা হবে না। একটা ভেরিয়েশনও হবে। প্রকৃতি ভেরিয়েশন পছন্দ করে। দেখছেন না সে। কত বিচিত্র ধরনের গাছপালা, জীবজন্তু তৈরি করেছে! সে যেমন পিপড়ার মতো ক্ষুদ্র প্রাণী তৈরি করেছে আবার দশটা হাতির সমান নীলতিমিও তৈরি করেছে।
মূল গল্পের বাইরের গল্পটা ইফতেখার মামাকে নিয়ে। মনে হয় তার মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে। মানসিক চেইন রিঅ্যাকশান। চেহারা হাবাগোবা টাইপ হয়ে গেছে। মাথা ঝুলে গেছে। থুতনি চলে এসেছে বুকের কাছাকাছি। সাথীর মৃত্যুর ধকল সামলাবার পর তাঁর সঙ্গে এটা আমার দ্বিতীয় দেখা। আমি বললাম, মামা, কেমন আছেন?
তিনি জড়ানো গলায় বললেন, ভালো না।
আমি বললাম, ভালো না কেন? কী হয়েছে?
তিনি জবাব দিলেন না। তাঁর মাথা আরো ঝুঁকে গেল। থুতনি সত্যি সত্যি বুকের সঙ্গে লেগে গেল। আমি বললাম, হাত অবশ হয়ে গেছে?
তিনি হ্যা-সূচক মাথা নাড়লেন।
আমি বললাম, বড় কোনো মিথ্যা কথা বলেছেন?
তিনি বিড়বিড় করে বললেন, কোনো মিথ্যা কথাই বলি নাই।
আমি বললাম, এক কাজ করুন। হজ্ব করে আসুন। হাত ঠিক হয়ে যাবে। টাকা কোনো সমস্যা না। টাকা দিচ্ছি। আজই দেব। চেক লিখে দেব।
মামা এইবার মাথা তুললেন। স্পষ্ট গলায় বললেন, তোমার টাকায় হজ্ব করব না।
আমি বললাম, কেন করবেন না? আমি খারাপ লোক, আমি খুনি–এই জন্যে?
তিনি স্থির হয়ে রইলেন। হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না।
আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম, মামা শুনুন, আমি খারাপ লোক না। আমি পাগল। পাগলদের অপরাধকে অপরাধ বলে ধরা হয় না। তাদের কোনো বিচারও হয় না। শুধু যে ইহকালে হয় না তা-না, পরকালেও হয় না। শেষ বিচারের দিনেও তাদের বিচার হবে না।
ইফতেখার মামা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তিনি যে আমাকে পরিষ্কার দেখতে পারছেন তা মনে হলো না। আমি বললাম, আপনার হাতটা ঠিক করা দরকার। যে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মানুষের দু’টা করে আছে তার একটা নষ্ট হলে অন্যটাও নষ্ট হয়ে যায়। একে বলে সিমপ্যাথিটিক রিঅ্যাকশান। মনে করুন আপনার ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুদিন পর দেখবেন আপনার বা চোখের জ্যোতিও কমতে শুরু করেছে।
ইফতেখার মামা বললেন, হজ্বে গেলে আমার এই রোগ সারবে না। কী করলে সারবে সেটা আমি জানি।
কী করলে সারবে?
তুমি যে মানুষ খুন করেছ এই কথাটা যদি সবাইকে বলি তাহলে রোগ সারবে।
তাহলে তো চিকিৎসা সহজ হয়ে গেল। আপনার যাকে বলতে ইচ্ছা বলুন। পরিচিতদের বললে কিছু হবে না। বলতে হবে পুলিশকে। এক কাজ করুন, এখুনি থানায় চলে যান।
মামা বিড়বিড় করে বললেন, আমি কাউকে কিছু বলতে পারব না।
কেন?
জানি না কেন।
আমি বলে দেব কেন? আমি বিপদে পড়ি এমন কিছুই আপনি করতে পারবেন না। কারণ আমি একজন সাইকোপ্যাথিক মানুষ। সাইকোপ্যাথিক মানুষরা তাদের চারপাশের মানুষদের এক ধরনের ঘোরের মধ্যে রাখে। তারা এই ঘোর থেকে বের হতে পারে না।
মামা বললেন, আমি যাই।
চলে যাবেন?
মামা জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, আপনি আমার বিষয়ে পুলিশের কাছে কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন। আমি কিছুই মনে করব না। আপনার এই রোগ কিন্তু ছড়িয়ে পড়বে। সর্বাঙ্গ অবশ। জীবন কাটছে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। অবস্থাটা চিন্তা করেছেন?
মামা ক্ষীণ গলায় বললেন, আমি পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু কিছু বলতে পারি নি।
আপনি কী করেছেন? ওসি সাহেবের সঙ্গে এক কাপ চা খেয়ে চলে এসেছেন?
চা খাই নি, চলে এসেছি।
মামা, আপনার কিন্তু পুলিশকে ঘটনাটা বলা দরকার ছিল। শুধু যে আপনার রোগমুক্তির জন্যেই দরকার ছিল তা-না। আমি যাতে এই ধরনের অপরাধ আর করতে না পারি তার জন্যেও দরকার ছিল। আমি তো এই ধরনের অপরাধ আরেকটা করতে পারি।
আরেকটা করবে?
করাটাই তো স্বাভাবিক।
করাটা স্বাভাবিক?
আপনার জন্যে স্বাভাবিক না। কিন্তু আমার জন্যে অবশ্যই স্বাভাবিক। একজন সুস্থ মানুষের জগৎ এবং একজন অসুস্থ মানুষের জগৎ এক রকম না। আপনার রিয়েলিটির সঙ্গে আমার রিয়েলিটির কোনো মিল নেই। মামা, আপনি পুলিশের কাছে যান। এখনই চলে যান। ড্রাইভারকে বলুন আপনাকে থানায় নামিয়ে দেবে। আমাদের এলাকাটা কোন থানার আন্ডারে? রমনা থানা?
মামা জড়ভরতের মতো এগুচ্ছেন। তার হাঁটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কাউকে কিছু বলতে পারবেন না। ব্যাধি তাঁকে ক্রমে ক্রমেই গ্রাস করবে। আহা বেচারা!
গল্পটা কেমন লাগছে
ভাই, আমার গল্পটা কেমন লাগছে?
রূপকথার গল্পের মতো না? রূপকথার গল্পে দুই রানী থাকে–সুয়োরানী ও দুয়োরানী। আমার গল্পেও তো দুই রানী একজন রূপা, আরেকজন কাঁসা।
রূপকথার গল্প শেষ হয় কীভাবে? শেষ লাইনটি থাকে এরকম—‘অতঃপর তাহারা সুখে দিন কাটাইতে লাগিল।’