তোমাকে চা বানিয়ে আনতে হবে না। তুমি বসো তো আমার পাশে।
রূপা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি এমন অসহায়ের মতো মুখ করে বসে আছ, আমার খুব খারাপ লাগছে।
আমি বললাম, রূপা, তুমি একটা কাজ কর–ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাক। তোমার ঘুম দরকার।
রূপা বলল, আমি তোমার পাশে বসে থাকব, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। তুমি হাতটা দাও তো, আমি তোমার হাতটা একটু ধরি।
আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। রূপা আমার হাত ধরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, তুমি এখন আর আমাকে আগের মতো দস্তা-কন্যা বলে ডাক না কেন?
এখন থেকে অবশ্যই দস্তা-কন্যা ডাকবে।
আমি বললাম, আচ্ছা।
রূপা বলল, আমি ছোটনের গোপন একটা ব্যাপার জানি। গোপন ব্যাপারটা শুনলে তুমি খুবই অবাক হবে।
গোপন ব্যাপারটা কী?
ছোটন তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে আলাপ করব। তোমার পরামর্শ নেব।
আলাপ কর নি কেন?
তুমি যদি আমার বোনটাকে খারাপ ভাব–এই জন্যে আলাপ করি নি। আমি চাই না কেউ আমার বোনকে খারাপ ভাবুক।
তাহলে ঠিক আছে।
আমি যে তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি তা কি তুমি জানো?
জানি।
কেন ভালোবাসি সেটা জানো?
জানি।
তাহলে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো তো কেন ভালোবাসি। আমি নিজে জানি না। আমার জানতে ইচ্ছা করে।
আরেক দিন বলি। আজ বাড়িতে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটল। এই সময়ে ভালোবাসা বাসি নিয়ে কথা বলা ঠিক না।
তুমি ঠিকই বলেছ। আচ্ছা শোন, আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। আমি কাঁদতে পারছি না। কেন বলো তো?
বলতে পারছি না।
কান্না দেখতে তোমার ভালো লাগে না। এই জন্যে আমি কাঁদছি না। আমি ঠিক করেছি তোমার ভালো লাগে না এমন কোনো কাজ আমি কখনো করব না। ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছি না?
হ্যাঁ, খুব ভালো সিদ্ধান্ত।
এতক্ষণ ধরে আমরা কথা বলছি, তুমি কিন্তু এখনো একবারও আমাকে দস্তাকন্যা বলে ডাক নি।
কেমন আছ দস্তা-কন্যা?
রূপা গাঢ় স্বরে বলল, ভালো আছি। আমি খুব ভালো আছি।
অনেক রাতে আমি ছাদে গেলাম। ডাক্তার সাহেব পেথিড্রিন ইনজেকশান দিয়ে রূপাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন। সহজে তার ঘুম ভাঙবে না। আমি দীর্ঘ সময় আকাশ দেখতে পারব। টেলিস্কোপ দিয়ে শখের এনোমারের আকাশ দেখা না, খালি চোখে আকাশ দেখা। আকাশে কোনো কোনো নক্ষত্র উজ্জ্বল, কোনো কোনোটি অনুজ্জ্বল। দীর্ঘ সময় এদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ সবগুলি নক্ষত্রকে সমান ঔজ্জ্বল্যে দেখতে চেষ্টা করে, তখন মস্তিষ্কে কিছু রি-এরেঞ্জমেন্ট হয়। তার ফল খুব ইন্টারেস্টিং। তখন মনে হয় সব নক্ষত্র হঠাৎ নিচে নেমে আসছে কিংবা যে তাকিয়ে আছে সে ভেসে ভেসে নক্ষত্রের দিকে যাচ্ছে।
যখন আকাশের তারাগুলি আমার চোখের দিকে নামতে শুরু করল তখন অবিকল ছোটনের গলায় কেউ একজন বলল, কী দেখছ?
আমি বললাম, তারা দেখছি। কাঁসা-কন্যা, কেমন আছ?
ভালো আছি। আমি সবসময় ভালো থাকি।
তুমি কোথায়?
আমি তোমার মাথার পাশে, পা ছড়িয়ে বসে আছি।
আমি যদি উঠে বসি তাহলে কি তোমাকে দেখতে পাব?
অবশ্যই দেখতে পাবে। তোমার রোগ অনেক বেড়েছে, কাজেই বেশিরভাগ সময়ই তুমি আমাকে দেখতে পাবে। তুমি যদি আমাকে বলো তোমার পাশে শুয়ে তারা দেখতে, তা হলে আমি তাই করব। তুমি তখন আমার গায়ে হাত রেখেও তারা দেখতে পারবে। কিংবা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার চোখের দিকেও তাকিয়ে থাকতে পার। চোখের মণিতে তারার প্রতিফলন দেখাটাও ইন্টারেস্টিং হবার কথা।
আমার কাছে তো পুরো ব্যাপারটাই ইন্টারেস্টিং লাগছে। কল্পনার মানুষের বাস্তব উপস্থিতি।
কাঁসা-কন্যা হাসল।
আমি বললাম, হাসছ কেন?
কাঁসা-কন্যা বলল, আমি হাসছি, কারণ, তোমার যে অসুখটা হয়েছে সেটা আসলেই মজার অসুখ। এই অসুখে বাস্তব-অবাস্তব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কখনো তোমার কাছে মনে হবে, আমি বাস্তব, রূপা কল্পনা।
আচ্ছা তুমি এখন কার মতো? রূপার মতো না-কি ছোটনের মতো।
তুমি আমাকে যার মতো ভাববে, আমি হব তার মতো।
কাঁসা-কন্যা, আমার পাশে এসে শুয়ে থাক। আস আমরা এক সঙ্গে তারা দেখি।
সে বাধ্য মেয়ের মতো আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐটাই কি সপ্তর্ষিমণ্ডল?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
সপ্তঋষির নামগুলি জানো?
অবশ্যই জানি–অন্ডু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অষ্টিরা, বশিষ্ট, মরীচ।
অরুন্ধতি নামের একটা তারা আছে না? অরুন্ধতি কোনটা? বশিষ্টের পাশের তারাটি অরুন্ধতি। দেখতে পাচ্ছ?
না।
চোখ খারাপ হলে অরুন্ধতি দেখা যায় না। আমার মনে হয় তোমার চশমা নিতে হবে।
আমাকে চোখের ডাক্তারের কাছে কবে নিয়ে যাবে বলো তো। আমি অরুন্ধতি তারাটা খালি চোখে দেখতে চাই।
নিয়ে যাব। খুব শিগগিরই নিয়ে যাব।
আমি কাঁসা-কন্যার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। তারাগুলি সত্যি সত্যি তার চোখে দেখা যাচ্ছে। বাহ মজা তো!
কাঁসা-কন্যা লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, চোখ বড় বড় করে কী দেখছ?
আমি বললাম, তারা দেখছি। তারাগুলি কি সুন্দর তোমার চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।
সে আদুরে গলায় বলল, উদ্ভট কথা বলবে না তো।
আমি বললাম, তুমি যে ধরনের কথা শুনতে চাও আমি ঠিক সেই ধরনের কথা বলব। ভালোবাসার কথা শুনতে চাও?
না।
না কেন?
আমার লজ্জা করবে।
তাহলে কি জ্ঞানের কথা শুনতে চাও? বিজ্ঞানের কথা। সৃষ্টি-তথ্য।
বলো শুনি।
এক্সপানডিং ইউনিভার্সের তথ্য জানো? আদিতে এই মহাজগৎ বিন্দুতে সীমাবদ্ধ ছিল। হঠাৎ কী যেন হলো। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। বিন্দু পরিণত হলো মহাজগতে এবং সেই জগত থেমে রইল না, চারদিকে ছড়িয়ে যেতে লাগল।