তার মানে?
মানুষকে সবচে’ বিরক্ত করতে পারে মাছি। সেই জন্যেই মাছি হতে চাই। মাছি হয়ে সবাইকে বিরক্ত করে মারব।
আপনি কি দয়া করে উঠবেন? প্লিজ।
আমি উঠলাম। এ দেশের একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছ থেকে Clean bill of mental health নিয়ে বাড়িতে চলে এলাম।
আমার আনন্দ হচ্ছে। আমার মনে কোনো রোগ নেই–এই ভেবে আনন্দ না। ডাক্তার আমার রোগ ধরতে পারছেন না–এই ভেবে আনন্দ। মানসিক অসুখ সম্ভবত একমাত্র অসুখ যে অসুখ ডাক্তাররা ধরতে না পারলে খুব আনন্দ হয়।
আমি ডাক্তার হলে ভালো করতে পারতাম। আধি ডাক্তারের কথা বলছি। মন-বিশেষজ্ঞ। রোগীর সঙ্গে দু’একটা কথা বলেই চট করে বলে দিতে পারতাম রোগীর কী হয়েছে। Silence of the lambs ছবিটা দেখেছেন? ডা. হানিবলের কথা মনে আছে?
না না, নিজেকে আমার কখনো ডা. হানিবল মনে হয় না। আমি নিজেকে বুদ্ধিমান এবং মজার একজন মানুষ বলে মনে করি। যে মানুষটির চিন্তা করার ক্ষমতা ভালো। সিদ্ধান্তে পৌঁছার ক্ষমতাও ভালো এবং লোকচরিত্র সম্পর্কে ভালো জ্ঞান আছে। যে মানুষটা জানে দুই-এর সঙ্গে দুই মিলালে কখন চার হয়, কখন বাইশ হয়।
আপনি নিশ্চয়ই আমাকে অহঙ্কারী ভাবছেন। আমি অহঙ্কারী না। আমি এমন একজন যার নিজের উপর আস্থা আছে। আস্থা থাকা দোষের কিছু না। বেশিরভাগ মানুষ বিনয় নামক হাস্যকর গুণের জন্যে নিজের উপর আস্থার ব্যাপারটা চেপে যায়। আমার মধ্যে বিনয়ের ছিটেফোঁটা নাই বলে আমি…
কী হাবিজাবি বলছি! মূল বিষয়ে আসি। মূল বিষয় হলো আমি ডা. হানিবলের মতো মনের ডাক্তার হলে ভালো করতাম। আমার মামা শেখ ইফতেখারের অসুখটা যেভাবে ধরলাম–তাঁর চোখের দিকে তাকিয়েই আমার মনে হলো সাথীর মৃত্যু তিনি স্বাভাবিকভাবে নেন নি। সামান্য সন্দেহ তাঁর মনে দানা বেঁধেছে। ইংরেজিতে বললে বলতে হয়–A crystal of suspision has formed. A tiny crystal.
কৃস্টালের সমস্যা হলো একটা দানা তৈরি হওয়া মাত্র আরো দানা তৈরি হতে থাকে, দানা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সময় নেয় প্রথম দানাটি।
ইফতেখার মামা তার স্বভাবমতো সব সমস্যা মিটালেন। ডাক্তারি সার্টিফিকেট জোগাড় করলেন ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফেকশনে রোগীর মৃত্যু। মওলানা ডাকিয়ে জানাজার ব্যবস্থা করলেন। আজিমপুর গোরস্তানে কবরের ব্যবস্থা করে সন্ধ্যার পর আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তখনি বুঝলাম একটা ঝামেলা তো হয়েছে। ইফতেখার মামা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কেন? আমাকে তিনি নিশ্চয়ই সান্ত্বনা দিতে আসছেন না। তিনি জানেন আমার সান্তনার প্রয়োজন নেই। এই জিনিস আমার লাগে না।
মামা কয়েকবার খুকখুক করে কেশে বললেন, বাবা, কেমন আছ?
আমি জবাব দিলাম না। জবাব দেবার প্রয়োজন নেই। আমি কেমন আছি এই সংবাদ সংগ্রহের জন্যে তিনি আসেন নি। তাঁর খুকখুক কাশির মতো প্রশ্নটাও উদ্দেশ্যহীন। তার চোখ দুটিও উদ্দেশ্যহীন মানুষের চোখের মতোই ছটফট করছে। আমি বললাম, আপনি কেমন আছেন?
তিনি আবারো খুকখুক করে কাশলেন। আমি বললাম, আপনার হাত কি ঠিক আছে? বড় ধরনের কোনো মিথ্যা কথা বলায় হাত অবশ হয়ে যায় নি তো?
তিনি মেঝের দিকে তাকিয়ে না-সূচক মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, আপনি কি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে এসেছেন?
ইফতেখার মামা মেঝে থেকে তার দৃষ্টি উপরে তুললেন, তবে আমার দিকে তাকালেন না। আমার পেছনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েটা মারা গেল কীভাবে?
আমি বললাম, ভয় পেয়ে মারা গেছে। কেউ একজন তাকে ভয় দেখিয়েছে। সেই ভয়টা সে নিতে পারে নি। মনে হয় মেয়েটার হার্ট দুর্বল ছিল।
ইফতেখার মামা বললেন, ও আচ্ছা।
আমি বললাম, ভয় দেখানোটা ছিল একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অংশ। হার্টের রিদমে ভয়ের প্রভাব বিষয়ক পরীক্ষা।
মামা আবারো বললেন, ও আচ্ছা।
আমি বললাম, আপনি আর কিছু জানতে চান?
মামার দৃষ্টি আবারো মেঝেতে নিবদ্ধ হলো এবং তিনি না-সূচক মাথা নাড়লেন। তিনি আর কিছু শুনতে চান না। তিনি যা জানতে এসেছিলেন তারচে’ বেশি জেনে গেছেন।
আমি বললাম, আপনি যদি আর কিছু শুনতে না চান তাহলে বাসায় চলে যান। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার শরীর। ভালো না।
ইফতেখার মামা বসেই রইলেন। মামার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগছে। পুরোপুরি ‘Confused state’-এর একজন মানুষ। এটা খুবই বিপদজনক অবস্থা। মানুষ বেশিক্ষণ কনফিউশান নিতে পারে না। মানব মস্তিষ্ক কনফিউশান থেকে বের হবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। যদি সে সফল হয় তাহলে ভালো। যদি সফল না হয় তাহলে মস্তিষ্ক কনফিউশানটাকেই সত্যি ধরে নিয়ে তার জগৎটা অতি দ্রুত সাজিয়ে ফেলে। তার জগৎ তখন হয়ে যায় কনফিউশানের জগৎ। A state of total confusion. A state of wrong reality. সেই অবস্থাটা ভয়াবহ।
আমি মামার দিকে ঝুঁকে এসে বললাম, মামা, বাসায় যান।
তিনি বললেন, আচ্ছা।
কিন্তু তিনি আগের জায়গাতেই বসে রইলেন। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। মানুষটা কনফিউশান থেকে বের হতে পারছে না। তাঁর মস্তিষ্ক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক চেষ্টা যে চালাচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে মামার দ্রুত শ্বাস নেয়া দেখে। তাঁর হার্ট অতি দ্রুত রক্ত পাম্প করছে। গ্যালন গ্যালন রক্ত চলে যাচ্ছে মস্তিষ্কে। অক্সিজেনে ভরপুর ধমনীর বিশুদ্ধ রক্ত। মস্তিষ্ক অতিরিক্ত পরিশ্রম করছে, তার অতিরিক্ত খাদ্য দরকার। তার প্রয়োজন বিশুদ্ধ অক্সিজেন।
জগৎ দুরকমের–বস্তুজগৎ ও মনের জগৎ
জগৎ দু’রকমের।