এই প্রশ্নগুলির উত্তরে আপনি যদি হ্যাঁ বলেন তাহলে সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোকের মনে বিরাট আনন্দ হবে। তিনি মনে মনে বলবেন, ‘তরে পাইছি’।
আপনার কি মনে আছে–শুরুতে আপনাকে বলেছিলাম যে, আমি আবারো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই? রূপার তথাকথিত ভাইয়ের কথা বলছি। প্রথমবার গিয়েছিলাম তার বাসায়, এবার যাই তাঁর চেম্বারে। মজার ব্যাপার হলো তিনি কিন্তু আমাকে চিনতে পারেন না। একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে সিজিওফ্রেনিকদের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো হয়, সাইকিয়াট্রিস্টদের স্মৃতিশক্তি হয় দুর্বল এবং ডেনটিস্টদের আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে সবচে’ বেশি।
সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক বললেন, কাইন্ডলি আপনার নামটা বলুন।
আমি নাম না বলে বললাম, স্যার, আমি বিরাট মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আপনি আমাকে সারিয়ে তুলুন। টাকা-পয়সা যা লাগে দেব। টাকা পয়সা আমার কাছে কোনো ব্যাপার না। আমি একজন ধনবান ব্যক্তি।
ভদ্রলোকের চোখ চকচক করে উঠল। আমাদের দেশে সাইকিয়াট্রিস্টরা রোগী পান না। অন্য ডাক্তাররা যেখানে টাকা গুনতে গুনতে হাতে ঘা করে ফেলেন, সাইকিয়াট্রিস্টদের সেখানে দেখা যায় উড়ন্ত মাছির সাইকোএনালিসিস করে সময় কাটাতে।
সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, আপনার সমস্যা কী?
আমার সমস্যা হলো আমি একজন সিজিওফ্রেনিয়ার রোগী।
আপনি কিসের রোগী সেটা আমি ঠিক করব। আপনার কী করে ধারণা হলো যে আপনি সিজিওফ্রেনিয়ার রোগী? যে রোগী সে কি তার রোগ বুঝতে পারে?
আমি বললাম, কেন পারবে না? আমার যদি রোজ কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে, প্লীহা বড় হয় তাহলে আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারি আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে।
সিজিওফ্রেনিয়া চোখ বন্ধ করে ডায়াগনোসিস করার রোগ না। আপনি দয়া করে অল্প কথায় আপনার সমস্যাগুলি বলুন।
অল্প কথায় বলব?
হ্যাঁ, অল্প কথায় বলুন। আপনি কি একা এসেছেন? সঙ্গে কাউকে নিয়ে আসেন নি? মানসিক রোগীরা কখনো নিজের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না।
স্যার, আমি ইচ্ছা করেই কাউকে আনি নি। কারণ আমি এমনসব কথা আপনাকে বলব যা তৃতীয় কোনো মানুষের শোনা উচিত না। স্যার, আমি কি শুরু করব?
হ্যাঁ, শুরু করুন।
অল্প কথায়?
হ্যাঁ, অল্প কথায়। প্লিজ।
আমি মজার গল্প বলছি এমন ভঙ্গিতে শুরু করলাম আমাদের বাড়িতে একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আমার স্ত্রীর বড়বোন মারা গেছেন এবং সবচে’ ছোট বোনটিও মারা যাবে মারা যাবে করছে। বড়বোন মারা গেছেন ভূতের ভয়ে। ছোটটি খুব সম্ভব মারা যাবে পিচ্ছিল ছাদ থেকে পিছলে উঠানে পড়ে। তৃতীয় মৃত্যু অর্থাৎ আমার স্ত্রীর মৃত্যুও অতি শিগগির ঘটবে, এই নিয়ে আমি চিন্তিত। আপনাদের সাইকিয়াট্রিস্টের ভাষায় এই মানসিক অবস্থাটির নাম হয়তো প্যারনয়া। কল্পিত বিপদের আশঙ্কায় অস্থির হওয়া। একের পর এক সবাই মারা যাচ্ছে–এরকম টেনশনের শিকার হওয়া।
কিছু মনে করবেন না, আপনি কি আমার কাছে আগে কখনো এসেছিলেন? আপনি কি সেই ব্যক্তি যে সারারাত টেলিফোন করে আমাকে জ্বালাতন করেছে?
আমি খুব বিস্মিত হয়েছি এরকম ভঙ্গি করে বললাম, আপনি ধরে ফেলেছেন। স্যার! জি এসেছিলাম। আমার স্ত্রী রূপাকে নিয়ে আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। স্যার, আপনার তো অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। আমি মুগ্ধ! সাইকিয়াট্রিস্টদের ভেতর এমন স্মৃতিধর মানুষ দেখা যায় না। আগের আমল হলে আপনার পায়ের ধুলা নিতাম। এই আমলে যে পায়ের ধুলা নেয় সবাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখে।
ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি গভীর সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি বললাম, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমার উপর খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। আমি কি চলে যাব? না-কি অতি সংক্ষেপে আমার সমস্যাটা আপনাকে জানাব।
আপনার সমস্যাটা কী?
আমি ডাক্তারের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে গলার স্বর নামিয়ে বললাম, আমি স্যার দু’জন স্ত্রীর সঙ্গে সংসার কাটাচ্ছি। একজনের নাম তো আপনাকে আগেই বলেছি, তার নাম রূপা; আরেকজনের নাম কাঁসা। একটা হলো নোবেল। মেটাল, অন্যটা শংকর ধাতু।
ডাক্তার আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন।
আমি আহত গলায় বললাম, সময় নষ্ট করছি?
অবশ্যই সময় নষ্ট করছেন। এখন আপনার কথা আমার পুরোপুরি মনে। পড়েছে। আপনি মনগড়া সব স্বপ্নের কথা বলে প্রথম দিন আমাকে চূড়ান্ত রকমের বিরক্ত করেছিলেন। আবারো বিরক্ত করতে এসেছেন।
স্যার, আমি কি চলে যাব?
অবশ্যই চলে যাবেন।
আপনার ফিস দিতে হবে না?
না, দিতে হবে না।
পাঁচশ’ টাকার একটা নোট দিয়ে যাই? আপনার সময় নষ্ট করেছি। সময়ের মূল্য।
দয়া করে আপনি উঠুন। আমাকে রোগী দেখতে হবে।
স্যার, আমি তো একজন রোগী। মানসিক রোগী।
আপনি রোগী না। আপনি মানসিকভাবে অতি সুস্থ একজন মানুষ।
চট করে এরকম সিদ্ধান্তে কী করে এলেন জানতে পারি?
মানসিক রোগীরা আর যাই পারুক রসিকতা করতে পারে না। হিউমার বোঝার এবং করার ক্ষমতাটা তাদের প্রথমেই নষ্ট হয়। আপনার সেই ক্ষমতা পুরোপুরি আছে।
এমন কি হতে পারে না স্যার–আমার যে সিজিওফ্রেনিয়া হয়েছে সেটা ভিন্ন। প্রজাতির? শুশুক যেমন ডলফিনেরই একটি প্রজাতি। ডলফিনের চোখ আছে। শুশুক জন্মান্ধ। হয়তো আমার হয়েছে শুশুকটাইপ সিজিওফ্রেনিয়া।
কেন বিরক্ত করছেন?
স্যার, মাঝে মাঝে মানুষকে বিরক্ত করতে আমার খুব ভালো লাগে। মাছি হতে ইচ্ছা করে।