অনেকদিন পর সেই রাতে কাঁসা-কন্যার দেখা পেলাম। আমি আকাশের তারা দেখছি, সে মিষ্টি গলায় বলল, কী দেখছেন?
আমি বললাম, তারা দেখছি।
সে হাসল। আমি বললাম, হাসছ কেন?
কাঁসা-কন্যা বলল, ছোটন বেচারির আশাভঙ্গ দেখে মজা পেয়ে হাসছি। বেচারি ভয়ঙ্কর কিছু আশা করেছিল। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান আছে না? ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।’
গানটা কি তুমি জানো?
কেন জানব না! আমি পৃথিবীর সব গান জানি, সব সুর জানি।
বেশ, তাহলে গানটা শোনাও।
এটা না, অন্য একটা গান শোনাই। তুমি তারা দেখতে থাক, আমি গান গাইতে থাকি।
আমাকে তুমি আপনি করে বলতে; আজ হঠাৎ ‘তুমি করে বলছ কেন?
আমরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি তো, এই জন্যে তুমি করে বলছি। আরো যখন কাছাকাছি আসব তখন তুমিও বলব না। কিছুই বলব না।
আরো কাছাকাছি আসার সুযোগ কি আছে?
অবশ্যই আছে। যখন কেউ থাকবে না, যখন শুধু তুমি আর আমি থাকব তখন…।
রূপা কোথায় যাবে?
কাঁসা-কন্যা বলল, এত কথা বলতে ভালো লাগছে না। এখন গান শোনো।
কাঁসা-কন্যা গান শুরু করল। আহারে কী মধুর কিন্নর কণ্ঠ! আমি তাকিয়ে আছি, গান হচ্ছে। আকাশের তারারা ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে। তাদের আলো নরম হয়ে চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কাঁসা-কন্যা গাইছে—
বঁধু, কোন্ আলো লাগল চোখে!
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে!
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে–
জন-জনম গেল বিরহশোকে।
জন্ম-জনম গেল বিরহ শোকে লক্ষ করেছেন কি সুন্দর লাইন? জন্ম গেল, আবার জনমও গেল। তিনি লিখতে পারতেন–জনম জনম গেল বিরহশোকে। সেটাও কম সুন্দর হতো না। কাজী নজরুল লিখেছেন–জনম জনম তব তরে কাদিব।’ এত সুন্দর লাইন মানুষের মাথায় আসে কী করে? মানুষ হলো অস্বাভাবিক ক্ষমতাধর এক প্রাণী। সে পারে না এমন কিছু কি আছে? তার চিন্তা এবং কল্পনার বাইরে কি কিছু আছে? পেটেন্ট অফিসের সামান্য একজন কেরানি মাথা চুলকাতে চুলকাতে হঠাৎ একদিন বলে বসলেন–আলোর গতি বিষয়টা তো গোলমেলে। গোলমালটা ঠিক করা দরকার। বের হয়ে গেল আপেক্ষিক তত্ত্ব। মানব সভ্যতা একদিনে হাজার বছর এগিয়ে গেল।
আমরা খুবই এলোমেলো পৃথিবীতে বাস করি। এলোমেলো ব্যাপারটা ঠিক করতে করতে এগিয়ে যাই। একটু এগুতেই আবার পঁাচ লেগে যায়। আমি ভয়ঙ্কর এলোমেলো এক জগতে বাস করছি। ঠিক করতে পারছি না। কাঁসা-কন্যা কি পারবে? তাকে জিজ্ঞেস করব?
না থাক, বেচারি দরদ দিয়ে গান করছে। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। গানের কোন লাইনে অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ে এটা দেখা দরকার। আমি কাঁসাকন্যার চোখের জল এবং গানের লাইন লক্ষ করছি। দু’টি পর্যবেক্ষণ কি একই সঙ্গে সম্ভব? হাইজেনবার্গের Uncertainity principle কী বলে? অবশ্যি অনিশ্চয়তার এই সূত্র Macro বস্তুজগতে কাজ করে না। কাঁসা-কন্যা কি Macro বস্তু?
আপনি কি শুশুক দেখেছেন
আপনি কি শুশুক দেখেছেন? কেউ কেউ বলে শিশু। দেখেছেন শিশু? নৌকায়। যাচ্ছেন, ভুস করে নদীর পানিতে কিছু একটা ভেসে উঠেই ড়ুবে গেল। অবশ্যই দেখেছেন। এই শুশুক যে ডলফিনের প্রজাতি তা কি জানেন?
জানেন না?
শুশুক হলো ডলফিনের একটা প্রজাতি। এই প্রজাতি জন্মান্ধ। এর জন্মান্ধ হবার পেছনের কারণটা জানেন? শুশুক থাকে নদীতে। এদেশের নদীর পানি প্রচণ্ড ঘোলা। এই পানিতে যে বাস করে সে কিছু দেখতে পায় না। কাজেই তার চোখ থাকা না-থাকা একই। প্রকৃতি তখন কী করল–শুশুকের চোখ বাতিল করে দিল। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা? উইপোকার মতো আরেকটি অন্ধ প্রজাতি জন্ম নিল। উইপোকা যে জন্মান্ধ তা জানেন না? প্রাণীজগতের অনেক প্রজাতিই জন্মান্ধ।
এখন লজিকে আসুন। মনে করুন আপনাকে নির্জন নির্বাসন দেয়া হয়েছে। আপনাকে খাবার দেয়া হয় ঠিকই কিন্তু কেউ আপনার কাছে আসে না। মানুষ তো দূরের কথা, পশুপাখিও না। মনে করুন কুড়ি বছর এইভাবে কেটে গেল। আপনার ভেতর ভালোবাসার যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তার কোনোরকম ব্যবহার হলো না। তখন প্রকৃতি কী করবে? আপনার ভালোবাসার ক্ষমতা বাতিল করে দেবে না? শুশুকের বেলায় যে-রকম হয়েছিল? বিশ বছর পর আপনি যদি আত্মীয়স্বজনদের কাছে ফিরে যান তখন দেখবেন কারো প্রতি কোনো ভালোবাসা, আকর্ষণ বিকর্ষণ কিছুই বোধ করছেন না।
আমার ক্ষেত্রেও হয়তোবা সে-রকম কিছু ঘটেছে। প্রকৃতি আমার ভেতর থেকে ভালোবাসার ক্ষমতা তুলে নিয়েছে। আনন্দিত হবার দুঃখিত হবার ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছে। আমি শুশুক প্রজাতির মতো অন্ধ হয়ে গিয়েছি।
অর্থাৎ আমার মানসিকতার স্বাভাবিক গঠনের অবনতি ঘটেছে। মানুষের ক্ষেত্রে যে এরকম ঘটবে তার উল্লেখ কিন্তু আমাদের ধর্মগ্রন্থে আছে। সূরা ইয়াসিনে আল্লাহপাক বলছেন—‘আমান নুআম্মিরহু নুনাক্কিছহু ফিল খালাক।’ যার অর্থ হলো, ‘আমি যাহাকে জীবনদান করি তাহার স্বাভাবিক গঠনে অবনতি ঘটাই।’ বুঝতে পারছেন কিছু?
আমি আল্লাহ বিশ্বাস করি কি করি না, এই বিষয় নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব না। আমার বিশ্বাসের সঙ্গে আমার গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সিজিওফ্রেনিক রোগীরা ধর্মবিশ্বাসী হয়। তারা গভীর বিশ্বাসে ধর্মকর্ম করে। কঠিনভাবেই করে। সাইকিয়াট্রিস্টরা যখন কোনো রোগীর সিজিওফ্রেনিয়া হয়েছে। বলে সন্দেহ করেন তখন তার প্রথম প্রশ্নই থাকে–’আপনি কি ধর্মকর্ম করেন? ধর্মের নিয়মকানুন কঠিনভাবে পালন করেন? নিশিরাতে প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন?