আমি বললাম, ছোটন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? রাতের খাবারের আয়োজন কর। খাবারটা যেন ভালো হয়। তোমার কি দুশ্চিন্তা লাগছে?
সে জবাব দিল না।
আমি বললাম, আজ রাতে যখন খেতে বসবে, সুন্দর করে সেজে খেতে বসবে। শাড়ি পরবে। কপালে টিপ দেবে। চুল বাঁধবে।
কেন?
তুমি এমনিতেই খুবই রূপবতী। সাজলে তোমার রূপ বাড়ে না কমে এটা দেখার ইচ্ছা। খুব রূপবতীরা সাজতে পারে না। সাজলে তাদের ভালো দেখায় না।
ছোটন শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। আমার সামনে থেকে চলে গেল না। দাড়িয়েই রইল।
রাতে খেতে বসেছি। ছোটন শাড়ি পরেছে, কপালে টিপ দিয়েছে, চুল বেঁধেছে। রূপা বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে?
ছোটন বলল, কিছু হয় নি তো।
রূপা বলল, এমন সাজগোজ করেছিস কেন?
ছোটন বলল, এমনি।
রূপা বলল, ঠিক করে বল তো ছোটন, তোর কি কোনো সমস্যা হয়েছে? কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছি তোর আচার-আচরণ যেন কেমন কেমন।
ছোটন বলল, আমার কিছু হয় নি।
রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে না ওর আচার-আচরণ অস্বাভাবিক?
আমি বললাম, মনে হচ্ছে।
রূপা বলল, কী মনে হচ্ছে বলো তো?
মনে হচ্ছে ও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। প্রবল ঘোর। কোনো মেয়ে যদি প্রথম কারো প্রেমে পড়ে তাহলে তার মধ্যে এমন ঘোর তৈরি হয়। তার মধ্যে শশক-প্রবৃত্তি চলে আসে।
কী প্রবৃত্তি?
শশক-প্রবৃত্তি।
সেটা আবার কী?
শশক হলো খরগোশ। খরগোশ কী করে দেখ না? কিছুক্ষণ চুপচাপ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। নড়বে না। প্রায় পাথরের মূর্তি। তারপর হঠাৎ ছুটে কিছুদূর গিয়ে আবার মূর্তির মতো হয়ে যাবে। প্রথম প্রেমের সময় মেয়েরা এরকম করে।
ছোটন হঠাৎ হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। আমি বললাম, তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছিলে?
ছোটন বলল, এখন বলতে চাচ্ছি না।
রূপা বলল, তোর কিছু বলার থাকলে বল। ঝিম ধরে থাকবি না। তোর এই খরগোশের মতো ঝিম ধরে থাকাটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না।
আমি বললাম, ছোটনের মনে একটা প্রশ্ন এসেছিল। প্রশ্নটা সে করত। হঠাৎ মনে হলো–প্রশ্নটা এমন কিছু জরুরি না। না করলে কিছু যায় আসে না। তাই না ছোটন?
হ্যাঁ।
তোমার প্রশ্নটা আমি জানি। উত্তর দেব?
ছোটন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। রূপা বলল, ওর মাথায় কী প্রশ্ন তুমি জানবে কী করে? তুমি তো থট রিডিং জানো না।
আমি বললাম, থট রিডিং জানব না কেন? কিছু তো অবশ্যই জানি। প্রকৃতি সমস্ত প্রাণীজগতকে থট রিডিং-এর ক্ষমতা দিয়েছে।
রূপা বলল, ছোটন কী প্রশ্ন করতে চাচ্ছিল যদি জানো তাহলে উত্তর দাও। ওর ভাবভঙ্গি আমার মোটেই ভালো লাগছে না।
আমি বললাম, ছোটনের প্রশ্ন ছিল প্রথম প্রেমে পড়ার সময় মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় শশক-প্রবৃত্তি। ছেলেদের মধ্যে কী দেখা যায়? ছোটন, এটাই তো তোমার প্রশ্ন? ঠিক ধরেছি না?
ছোটন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
আমি বললাম, প্রথম প্রেমে পড়লে ছেলেদের মধ্যে দেখা যায় বানর-প্রবৃত্তি। বানর যেমন অকারণে লাফ ঝাপ দিয়ে ডিগবাজি খায়, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালায়, প্রথম প্রেমে পড়া পুরুষের ক্ষেত্রে তাই হয়। লাফ ঝাপ ডিগবাজি। সবাইকে জানানো–দেখ আমি প্রেমে পড়েছি।
রূপা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মনে হচ্ছে সেও কিছু বলতে চাচ্ছে। সে কিছু বলল না। ছোটনের প্লেটে ইলিশ মাছ তুলে দিল।
ছোটন বোনের দিকে একবার তাকিয়ে খাওয়া বন্ধ করে উঠে চলে গেল।
রূপা বিস্মিত হয়ে বলল, ওর কী হয়েছে?
আমি নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলাম। হাত ধুতে ধুতে রূপাকে বললাম, আমি কিছুক্ষণ ছাদে শুয়ে থাকব। তারা দেখব। ছোটনকে দিয়ে আমার কাছে এক কাপ চা পাঠিও। ওকে নিরিবিলিতে জিজ্ঞেস করব ওর কী হয়েছে?
আমি ছাদে পাটি পেতে শুয়ে আছি। আকাশে তারা আছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখা যাচ্ছে। প্রশ্নবোধক চিহ্নের এই সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। যেন কেউ একজন তার প্রশ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশের গায়ে।
দুলাভাই, চা নিন।
ছোটন চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এক দৃষ্টিতে আকাশ দেখছিলাম বলেই বোধহয় তাকে লক্ষ করি নি। আমি বললাম, কেমন আছ ছোটন?
সে যন্ত্রের মতো বলল, ভালো। এখন বলুন আপনি আমার কাছে কী চান? আমাকে কী করতে হবে?
আমি চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললাম, তোমাকে যা করতে হবে তা হলো সবসময় সুন্দর করে সেজেগুজে থাকতে হবে। হাসতে হবে। দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করা চলবে না।
এই আপনার চাওয়া?
হ্যাঁ, এই আমার চাওয়া।
এটাকে আপনি কেন বলছেন ভয়ঙ্কর অন্যায় চাওয়া?
তুমি দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ। পরিবারের দু’জন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে আমি তোমাকে বলছি হাসিখুশি থাকতে, সেজেগুজে থাকতে এটা অন্যায় না? এই চাওয়া কি ভয়ঙ্কর চাওয়া না?
ছোটন বলল, এখন কি আমি চলে যাব?
হ্যাঁ, যাও।
তারপরেও ছোটন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। আমি যখন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারো আকাশ দেখতে থাকলাম তখন তার পায়ের শব্দ শুনলাম। সে চলে যাচ্ছে। পায়ের শব্দেই বলে দিতে পারছি সে এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছে।
আপনি কি বুঝতে পারছেন ছোটন মেয়েটি এই ঘটনার পর আমার প্রেমে হাবুড়ুবু খেতে থাকবে? একবার ড়ুববে আবার ভাসবে। আবার ড়ুববে। শুরু হবে ভাসা ড়ুবার খেলা। নানান জটিলতা তৈরি হবে তার মনে। ত্রিমুখি জটিলতা। একদিকে তার দু’কুল ভাসানো প্রেম। অন্য আরেক দিকে তার অতি আদরের বোন রূপা, রূপার সংসার। তৃতীয় দিকে তার মৃতা বড় বোন এবং পিতা। ত্রিমুখি টানাটানির যন্ত্রণা থেকে সে মুক্তির পথ খুঁজবে। মুক্তির পথও কিন্তু আমি দেখিয়ে দিয়েছি। নিজে রেলিং-এ দাঁড়িয়ে ঝাঁপ দেয়ার কথা বলেছি। সেই স্মৃতি অবশ্যই ছোটনের মাথায় ঢুকে গেছে। সেই স্মৃতি ড়ুব দিয়ে আছে মস্তিষ্কের সাব-কনসাস লেভেলের নিচে। যথাসময়ে সেই স্মৃতি বের হয়ে আসবে। যাতে বের হয়ে আসে, সূক্ষ্মভাবে সেই চেষ্টা আমি করব। আমাকেও এগুতে হবে সাবধানে। ডমিনো প্রাসাদ তৈরি হয়েছে। টোকা দিলে সেই প্রাসাদ ভেঙে পড়বে। কোন দিকে ভাঙবে তা নির্ভর করবে টোকাটা কোথায় দেয়া হবে তার উপর।