পরের দিনের কথা। দু’বোন ঝিম ধরে বারান্দায় বসে আছে। আমি তাদের কাছে গিয়ে ছোটনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম, তোমরা দু’জন সবসময় দেখি মূর্তির মতো বসে থাক। এটা তো ঠিক না। কাজকর্ম শুরু কর। কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাক। ছোটন, তোমার কলেজ নেই?
ছোটন মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, আছে। যাব না।
সে সম্ভবত আমার চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পাচ্ছিল। আমি বললাম, কলেজ আছে কিন্তু যাবে না তা কেন হবে? ডাক্তারি পড়াটা তো এমন না যে ঘরে বসে পড়ে পুষিয়ে নেবে। তুমি অবশ্যই যাবে। চল, আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।
রূপা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছ। চল, আমরা দুজন মিলে ওকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আসি।
আমি বললাম, তোমরা দু’বোন সবসময় এক সঙ্গে ট্যাগ হয়ে থাকবে এটা কেমন কথা? তোমার যাবার কোনো দরকার নেই। তুমি থাক। আমি নামিয়ে। দিয়ে আসছি।
রূপা বলল, ঠিক আছে এটাই ভালো। তুমিই নামিয়ে দিয়ে আস।
ছোটন ভীত গলায় বলল, না আপা, না। আমি যাব না।
রূপা বলল, তুই অবশ্যই যাবি।
আমি ছোটনকে কলেজে নামিয়ে দিতে গেলাম। আমার অতিরিক্ত আগ্রহের কারণে ছোটন খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমি নিশ্চিত সে কলেজে যাবার পথে আমি তার সঙ্গে কী আচরণ করব তা নিয়েই তার দুশ্চিন্তা। কী করবে মানুষটা? চট করে হাত ধরে ফেলবে? তার দিকে ঘেঁসে আসবে? গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে গদগদ গলায় প্রেমের কথা বলার চেষ্টা করবে?
ছোটন যা ভাবছে সে-রকম কোনো কিছুই করা যাবে না। উদ্ভট কিছু করা যাবে না। মেয়েরা প্রেমিকের উদ্ভট আচরণ পছন্দ করে। অন্যদের কাছ থেকে উদ্ভট আচরণ আশাও করে না, পছন্দও করে না।
আমি গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসলাম। পেছনের সিটে ছোটনের সঙ্গে বসলাম না। গাড়িতে সারা পথে একটি কথাও বললাম না, একবারও পেছন ফিরে তাকালাম না। ছোটন গাড়ি থেকে নেমে আমার জানালার পাশে ঝুঁকে এসে ভয়। পাওয়া গলায় বলল, আমি যাই।
আমি ছোটনের দিকে না তাকিয়ে বললাম, আমি বুঝতে পারছি আমার অদ্ভুত কথাবার্তায় তোমার খুব মন খারাপ হয়েছে। তোমার চেয়ে একশ’ গুণ মন। খারাপ হয়েছে আমার। তুমি কিছু মনে করো না। আমি ঠিক করেছি, যে অপরাধ করেছি তার জন্যে আমি নিজেকে শাস্তি দেব।
ছোটন বলল, কী শাস্তি?
আমি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, সেটা তোমার জানার দরকার নেই।
ছোটনকে দেখে মনে হলো সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তবে আমি জানি এই স্বস্তি সাময়িক। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মধ্যে জন্ম নেবে হতাশা। এবং দুঃখবোধ। কী রকম দুঃখবোধ–ব্যাখ্যা করি? মনে করুন সাত-আট বছরের একটি শিশু হঠাৎ রাস্তায় তার খুব পছন্দের খেলনা কুড়িয়ে পেয়েছে। খেলনাটা হাতে নিতে তার খুব ইচ্ছা করছে কিন্তু সাহস করে নিতে পারছে না। অন্যের খেলনা কেন সে নেবে? তারপরে সে ঠিক করল সে খেলনাটা বাড়িতে নিয়ে যাবে না, শুধু হাতে নিয়ে একটু দেখবে। এই ভেবে যেই সে খেলনার দিকে তাকাল সে দেখল খেলনাটা নেই। এরকম কিছু যদি ঘটে তাহলে শিশুটির মনে যে দুঃখবোধ তৈরি হবে, ছোটনের মনেও ঠিক এরকম দুঃখবোধই তৈরি হয়েছে। আমি সেই দুঃখবোধকে ব্যবহার করে এগুব।
কেন এরকম করছি?
আমি এক ধরনের খেলা খেলছি। খেলার মধ্যে সবচে’ আনন্দময় খেলা হলো মনের খেলা। এই খেলা সবাই খেলতে পারে না। কেউ কেউ পারে। যারা পারে। তারা এই খেলা খেলে খুব আনন্দ পায়। আমি পারি।
সে-রাতে আমরা তিনজন খেতে বসেছি। আমি প্লেটে ভাত নিলাম। ইলিশ মাছ ভাজার প্লেটটা কাছে টেনেই হাত গুটিয়ে নিয়ে বললাম, আমি খাব না।
রূপা বলল, কেন, ক্ষিধে হয় নি?
আমি বললাম, ক্ষিধে হয়েছে। কিন্তু আমি খাব না। না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দেব।
ছোটন চমকে আমার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। রূপা বিস্মিত হয়ে বলল, নিজেকে কষ্ট দেবে কেন?
আমি বললাম, আমি পাপ করেছি। পাপের শাস্তি দেয়ার কেউ নেই। আমাকেই শাস্তিটা দিতে হবে।
রূপা বলল, কী পাপ করেছ?
আমি বললাম, সেটা তোমার জানার দরকার নেই।
পরের দু’দিন এবং দুই রাত্রি সর্বমোট আটচল্লিশ ঘণ্টা আমি পানি ছাড়া কিছুই খেলাম না। রূপা এবং ছোটন হতভম্ব হয়ে গেল। আটচল্লিশ ঘণ্টা পার। হবার পর ছোটনের সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হলো। ছোটন এসে বলল, দুলাভাই, আপনি যদি অনশন ভঙ্গ করেন তাহলে আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব। আমার নিজের স্বার্থে আমি এটা বলছি না। আপার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছি। আপনি লক্ষ করছেন না যে আপা পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছে। সে কিছুই। খেতে পারছে না। যা খাচ্ছে বমি করে দিচ্ছে। সে যে আপনাকে কতটা ভালোবাসে তা আপনি জানেন না। কারণ অন্যের ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। আপার একটা ডায়েরি আছে। ডায়েরিটা পড়ে দেখবেন।
আমি ছোটনের কথা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, আমি অনশন ভঙ্গ করলে তুমি আমার যে-কোনো কথা শুনবে?
হ্যাঁ।
অন্যায় কথাও শুনবে?
হ্যাঁ।
ভয়ঙ্কর অন্যায় কথাও শুনবে?
হ্যাঁ।
বেশ, রাতে তোমাদের দু’বোনের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসব। রাতের খাওয়া শেষ হবার পর আমি জর্দা দিয়ে একটা পান খাব। একটা সিগারেট ধরাব–তারপর কথাটা বলব। ঠিক আছে?
ছোটন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ঠিক আছে।
আমি বললাম, মনে রেখো, তুমি কিন্তু বলেছ আমার ভয়ঙ্কর অন্যায় আবদারও তুমি রাখবে।
ছোটন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। পাথরের মূর্তির সঙ্গে তার একটাই তফাত–পাথরের মূর্তির ঠোট কাঁপে না, ছোটনের ঠোট কাপছে। ছোটনের মনে হয় শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। সে হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি তার সমস্ত চিন্তা চেতনায় আছে–ভয়ঙ্কর অন্যায় চাওয়াটা কী হতে পারে?