ছোটন, তুমি ভুল করছ। মানুষ হিসেবে আমি মোটেই স্বাভাবিক না। আমার মাথায় অনেক এলোমেলো ব্যাপার আছে যা তুমি বা তোমার আপা কেউই
জানে না।
[ভাই, লক্ষ করছেন যে আমি সত্যি কথা বলছি। এই সত্যের মাঝে ছোট ছোট মিথ্যা ঢুকাব। সত্য হলো স্বর্ণ আর মিথ্যা হলো খাদ। সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মেশানোয় সত্য হবে কঠিন এবং ঝলমলে। আমি যে ছোটনকে নাড়া দিতে শুরু করেছি–এটা বুঝতে পারছেন? ছোটনের মুখ থেকে কিন্তু কান্না সম্পূর্ণ চলে গেছে। এখন তাকে আমি বড় শকটা দেব।]
ছোটন শোন, কারো শরীরে যদি দগদগে ঘা হয় সে কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করে ঘা লুকিয়ে রাখতে। মনের অসুখ বিষাক্ত ঘায়ের মতো। মানুষ এই বিষাক্ত ঘা। কাউকে দেখিয়ে বেড়ায় না। লুকিয়ে রাখে।
আপনি এত নিশ্চিত হলেন কীভাবে যে আপনার সত্যি সত্যি মনের অসুখ আছে?
তোমরা দু’বোন এ বাড়িতে উঠে আসার পর থেকে আমার তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে তোমার রূপা আপাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। তখনি বুঝেছি আমার অসুখটা মারাত্মক পর্যায়ের।
আপনি এসব কী বলছেন?
[বড় শকটা দিলাম। এরচে’ও বড় শক আছে। সেটা এখনি দেয়া হবে। প্রথম শকটা সামলানোর আগেই দেয়া হবে। কামারের দোকানে কামারকে লোহার কাজ করতে দেখেছেন? কামার কী করে, আগুনে পুড়িয়ে লোহাকে টকটকে লাল করে। তারপর সেই লোহাকে বাঁকায়। আমিও তাই করছি। বড় শকটা দিয়ে লোহা গনগনে করেছি। এখন আরেকটা শক দিয়ে লোহা বাঁকানো হবে। Ready get set go…]
ছোটন শোন, মন দিয়ে শোন, আমি এখন যা বলব তা শুনলে তুমি আমাকে ভয়ঙ্কর খারাপ ভাববে। তোমার কাছে মনে হবে আমার চেয়ে খারাপ মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেয় নি। তুমি যা ইচ্ছা ভাব। আমাকে আমার কথা বলতেই হবে। যে-কোনো কারণেই হোক তুমি এ বাড়িতে উঠে আসার পর আমার মনে হলো আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।
দুলাভাই, আপনি এসব কী বলছেন?
কথা বলবে না। প্লিজ! আমি আগে কী বলছি মন দিয়ে শোন, তারপর চিক্কার চেঁচামেচি যা ইচ্ছা কর। যখন মনে হলো তোমাকে ছাড়া বাঁচব না–তখনি মাথায় এলো তাহলে গলা টিপে রূপাকে খুন করে ফেলি। ছোটন, এখন কি বুঝতে পারছ যে আমার মাথা খারাপ?
বুঝতে পারছি। আমি আপনার পায়ে পড়ি, আপনি এইসব কিছুই আপাকে জানাবেন না। আপা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে। কষ্টেই সে মরে যাবে।
বলো আমি কী করব? আমি কি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ব? ছোটন, তুমি আমার কাজটা সহজ করে দাও। আমি রেলিং-এর উপর দাঁড়াচ্ছি। তুমি ধাক্কা দিয়ে আমাকে নিচে ফেলে দাও। আমার পক্ষে নিজে নিজে লাফ দেয়া সম্ভব না। পাগলরা সাহসী হয়। কিন্তু আমি সাহসী না। আমি ভীতু।
বলতে বলতে আমি টলোমলো ভঙ্গিতে রেলিং-এ উঠে দাঁড়ালাম। ছোটন। আতঙ্কিত গলায় বলল, দুলাভাই, আপনি নামুন। আপনার পায়ে পড়ি, আপনি। নামুন।
তুমি যদি আমার প্রতি সামান্য দয়া কর তাহলে নামব।
আপনি আগে নামুন। প্লিজ প্লিজ!
আমি নামলাম। নেমেই গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করলাম—
প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।
ছোটন ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের এই অশ্রুর ধরন অন্য।
নিজের অভিনয় প্রতিভায় আমি নিজেই চমকৃত হলাম। মনে হলো শেক্সপিয়রের নাটকে একই সঙ্গে দুটি চরিত্রে অভিনয় করছি, Hamlet এবং Ghost.
Hamlet : Alas poor Ghost.
Ghost : Pity me not, but lend thy serious hearing to what I shall unfold.
Hamlet : Speak, I am boond to hear.
Ghost : So art thou to revenge.
একটি তরুণী মেয়ে যদি হঠাৎ কোনো ছেলেকে এসে বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচব না। তখন ছেলেটির মানসিক অবস্থা কী হয়? সে আনন্দে আত্মহারা হয়। কিছুক্ষণ সে থাকে On the top of the world. তারপর সে চারদিকে এই গল্প ছড়িয়ে দেয়। পরিচিত অপরিচিত সবাই এই গল্প কয়েকবার শুনে ফেলে। যারা আশেপাশে থাকে না তাদেরকে চিঠি লিখে জানানো হয়–তুমি শুনে খুবই আশ্চর্য হবে, লিলি নামের অত্যন্ত রূপবতী এক তরুণী গত বৃহস্পতিবার বিকাল চারটা পঁচিশ মিনিটে হঠাৎ করে…। যুবকটি এই গল্প যতই ছড়াতে থাকে ততই তার আবেগ কমতে থাকে। ঘটনার নভেলটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। সে তখন অপেক্ষা করতে থাকে কখন অন্য কোনো তরুণী তাকে এসে এ জাতীয় কথা বলবে।
মেয়েদের বেলায় এই ব্যাপারটি একেবারেই ঘটে না। কোনো তরুণীকে যদি কোনো যুবক এসে বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তখন তরুণী আনন্দে আত্মহারা হয় না, বরং খানিকটা ভীত হয়ে পড়ে। সে এই ঘটনা কাউকেই জানায় না। যে কারণে ঘটনাটা তার নিজের মনের ভেতরে বড় হতে থাকে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে পুরো বিষয়টা মাথা থেকে মুছে ফেলতে। যতই সে চেষ্টা করে ততই এই ঘটনা শিকড় গজিয়ে বসতে থাকে। এক সময় তরুণীটির মনে হয়–আহারে বেচারা! সত্যি বোধহয় সে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। এক সময় সে ‘আহারে বেচারা’কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। দু’জন এক সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছে। ছেলেটা তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সে বিরক্ত হয়ে বলল, সবসময় তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাক কেন? লোকে কী ভাববে। ছেলেটা গাঢ় স্বরে বলল, ভাবুক যার যা ইচ্ছা। এই বলে সে আগের মতোই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে লাগল।
ভাই, বলুন তো আমার এনালাইসিস ঠিক আছে না? এনালাইসিসটা অবশ্যই অতি সরলীকরণ দোষে দুষ্ট। তারপরেও মনে হয় ঠিক আছে। যদি এনালাইসিস ঠিক হয় তাহলে অবশ্যই ছোটন মেয়েটি আমাকে নিয়ে নানান চিন্তাভাবনা শুরু করবে। চিন্তাভাবনা পানির মতো। যে পানি খাল দিয়ে প্রবাহিত। কোন দিকে প্রবাহিত হবে তা নির্ভর করবে খালটা কোন দিকে কাটা হবে। খাল অবশ্যই ছোটন নিজেই কাটবে, তবে আমাকে সাহায্য করতে হবে। সাহায্য করা মানে। খাল কাটা নিয়ন্ত্রণ করা। আমি আগ্রহ নিয়েই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় নামলাম।