তখনো আমি বুঝতে পারি নি রূপা আমাকে পুরোপুরি পাগল ধরে নিয়েছে। দড়িটা যে আমি চেয়ার ঝুলানোর জন্যে টানিয়েছি–তা কিছুতেই তাকে বিশ্বাস। করানো গেল না। সে ধরেই নিল আমার মূল পরিকল্পনা ছিল ফাঁসিতে ঝুলা। শেষটায় মত পরিবর্তন করে আমি চেয়ার ঝুলিয়ে দিয়েছি।
আমার জীবনযাপন পদ্ধতি আর দশজন মানুষের মতো না, তা ঠিক। আর দশজন মানুষের মতো না হওয়ার পেছনে যুক্তিও আছে। আর দশটা মানুষ অফিস করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে। আমি কিছুই করি না। দিন-রাত ঘরে থাকি। দিনরাত যে ঘরে বসে থাকে তার মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার খেলা করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কথায় আছে না—
‘আলসের চোখে কিলবিল করে আইডিয়া
উইপোকা বলে চল ভাই তারে খাই গিয়া।’
আপনি যদি বুদ্ধিমান হন তাহলে নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে ধরে ফেলেছেন যে আমার অর্থবিত্ত প্রচুর আছে। আমাদের দেশের খুব কম মানুষেরই গ্রামের বাড়িতে দালান আছে। আমার যে আছে তা তো আগেই বলেছি। সে দালানও দেখার মতো। হুলুস্থুল ব্যাপার। গ্রীক আর্কিটেকচার টাইপ বিশাল বিশাল খাম্বা। আপনি রাজি হলে একবার আপনাকে দেখিয়ে নিয়ে আসব। আমার বাবা ব্যবসা করতেন। তিনি ছিলেন ভাগ্যবান ব্যবসায়ী। যাতে হাত দিয়েছেন তাই ফুলে ফেপে একাকার হয়েছে। তার বিপুল বিত্তের বড় অংশই তাঁর মাথা খারাপ হবার পর আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে যা পাওয়া যায় তাও কম না। ঢাকা। শহরে দু’টি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স আছে, আমি যার মালিক। ব্যাংকে নগদ অর্থের পরিমাণও কম না। সেই অর্থে যেহেতু হাত দেয়া হয় না, তা দিনে দিনে বেড়ে একটা হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি করছে। হুলুস্থুল’ শব্দটা আমি ঘনঘন ব্যবহার করি। কিছু মনে করবেন না। এটা আমার মুদ্রাদোষ। মুদ্রাদোষটা পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। তিনি বলতেন–’হুলুসতুলুস’।
আমি থাকি পুরনো ঢাকায় আমার দাদাজানের আদি বাড়িতে। বাড়িটি ছোট এবং দোতলা, তবে অনেকখানি জায়গা নিয়ে। গাছ-গাছরায় জঙ্গলের মতো হয়ে থাকে। সেই গাছগুলিতে চারটা বাদর থাকে। বাঁদরগুলির সঙ্গে গল্প করে আমার অনেকটা সময় কাটে।
আমার কথাবার্তা এরা বেশ আগ্রহ নিয়ে শোনে এবং আমার ধারণা এরা। খানিকটা বুঝতেও পারে। মানুষের সঙ্গে আমরা যখন গল্প করি তখন কী হয়? যে শ্রোতা সে কিছুক্ষণ পর পর ‘হুঁ’ দিয়ে গল্পটা চালিয়ে নিতে সাহায্য করে। আমার বাঁদর-বন্ধুরাও তাই করে। গল্প বলার সময় খানিকক্ষণ পর পর ‘হু’ জাতীয় শব্দ করে এবং মাথা নাড়ে। এদের সময় দেয়াটাও রূপা আমার পাগলামির প্রকাশ বলেই ধরে নিল। যখন আমি বাঁদরের সঙ্গে গল্প করতাম, সে জানালা দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখত। আমি তাকালেই জানালার পর্দা ফেলে দিত।
বেঁচে থাকার জন্যে যাকে কোনোরকম কাজকর্ম করতে হয় না, তার জীবনযাপন পদ্ধতি একটু আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। রূপার কাছে এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক বলে মনে হলো। সে বাস করতে লাগল ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে। আমি তেমন গুরুত্ব দিলাম না। আমার ধারণা ছিল সে দ্রুত আমার আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আমি তার মনের সন্দেহ দূর করার তেমন চেষ্টাও করলাম না, তবে লক্ষ করলাম আমাকে সুস্থ করে তোলার প্রবল চেষ্টা সে চালাচ্ছে। যেমন, এক রাতে ঘুমুতে যাবার সময় সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, এই ট্যাবলেটটা খেয়ে ঘুমাও।
আমি বললাম, কী ট্যাবলেট?
ফ্রিজিয়াম। খেলে আরামে ঘুমুবে। এক ঘুমে রাত কাবার হয়ে যাবে।
আমার ঘুমের তো কোনো সমস্যা নেই। আমি এক ঘুমেই রাত কাবার করে ফেলি। শুধু রাত না, দিনেরও খানিকটা অংশ কাবার করি। সকাল নটার আগে ঘুম থেকে উঠি না। কাজেই তুমি নিশ্চিত থাকতে পার যে আমার ঘুমের কোনো সমস্যা নেই।
সমস্যা আছে। প্রায়ই তুমি রাতে ছাদে শুয়ে থাক।
ঘণ্টাখানিক বা ঘণ্টা দুই শুয়ে থাকি। তাতে আমার কোনো অসুবিধা তো হয়। দিনে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেই।
প্লিজ খাও না।
আমাকে ট্যাবলেট খাওয়ানোর বুদ্ধি তোমাকে কে দিয়েছে? তোমার বড় আপা?
রূপা চুপ করে রইল। তার মানে রূপার বড় বোন সাথী এই কাণ্ড করেছে।
রূপারা তিন বোন। বড় বোন ডাক্তার। মিটফোর্ড হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। সবচে’ ছোটটিও ডাক্তার হবার চেষ্টায় আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। রূপা পড়েছে ইংরেজি সাহিত্য। এরা নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবারের। বাবা পোস্টাল সার্ভিসে ছিলেন। বর্তমানে রিটায়ার করেছেন। মালিবাগে তাদের ছোট্ট দোতলা বাড়ি আছে। যার দোতলাটা ভাড়া। সংসার চলছে পেনশনের টাকায় এবং বাড়ি ভাড়ার টাকায়। বিয়ের পর ঐ বাড়িতে আমি মাত্র দু’বার গিয়েছি। তৃতীয়বার যাবার রুচি হয় নি। ওরাও আমাকে নিতে চায় নি। সম্ভবত রূপার মতো তাদের পরিবারের সবার ধারণা আমি উন্মাদ বিশেষ। শেষবারের মতো যখন ও বাড়িতে গেলাম, আমার শ্বশুরসাহেব সারাক্ষণ তটস্ত হয়ে রইলেন। সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাবার সময় দর্শকরা সাপের দিকে যেমন চোখে তাকায়, শ্বশুরসাহেবের দৃষ্টিও সে-রকম। তিনি অনেক ইতস্তত করে বললেন, বাবা, তুমি শুনলাম দিনরাত বাড়িতে থাক। কখনো বের হও না…।
আমি বললাম, ঠিকই শুনেছেন। বাইরে বেরুবার প্রয়োজন হয় না বলে বের হই না। তা ছাড়া ভিড় হৈচৈ আমার পছন্দ হয় না। মাথা ধরে যায়।
তবু লোকজনের সঙ্গে মিশলে মন প্রশান্ত থাকে। আমার মন প্রশান্তই আছে।