গ্রীষ্মতাপে উম্মা বাড়ে ভারি উগ্রমূর্তি
গায়ে কালো মোটা মোটা ছাঁটাছোটা কুর্তি।
দেখেছেন আমি কত মন দিয়ে পড়ি? মন দিয়ে যেমন পড়ি–জীবনটাকে সে-রকম মন দিয়েই দেখার চেষ্টা করি। জীবনের ব্যাখ্যায় আমি ভুল করতে পারি কিন্তু জীবনকে দেখায় কোনো ভুল নেই।
আপনারা মানুষের মাথার ভেতরের আলোকিত করিডোরগুলি জানেন, কিন্তু অন্ধকার করিডোরগুলি জানেন না। জানতে চানও না। আমি জানতে চাই।
গল্পে ফিরে যাই?
পৃথিবীতে তিন রকম বাড়ি আছে। সাধারণ বাড়ি; যেখানে লোকজন কখনো হাসে, কখনো কাঁদে।
কান্না বাড়ি; যেখানে সবসময় কেউ না কেউ কাদছে।
হাসি বাড়ি; যেখানে কেউ না কেউ সবসময় হাসছে।
সাথীর মৃত্যুর পর আমার বাড়িটা হয়ে গেল কান্না বাড়ি। দুই বোন সবসময় কাঁদছে। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তাদের কান্না দেখতে লাগলাম। অনেক কিছু লক্ষ করলাম, যা আগে লক্ষ করি নি। যেমন, দীর্ঘস্থায়ী কান্না যখন চলে তখন এক সময় চোখের পানি শুকিয়ে যায়। শুরু হয় অশ্রুশূন্য কান্না। আবার চোখে পানি আসে ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের মাথায়।
কী বললেন, সাথীর মৃত্যুর ব্যাপারে আমাকে কেউ সন্দেহ করেছে না-কি?
না তো! সন্দেহ কেন করবে? তাছাড়া আমি তো রূপা এবং তার ছোটবোনকে বলেছি যে আমি জানালা দিয়ে সাথীর মুখে টর্চের আলো ফেলেছি। আমি সত্য গোপন করি নি। তবে পূর্ণ সত্য বলি নি। আমি বলেছি Half truth. অর্ধ সত্য মিথ্যার চেয়েও খারাপ। এটা তো নিশ্চয়ই জানেন।
টর্চলাইটের ব্যাপারটা আমি কীভাবে বলেছি শুনুন। আমি রূপাকে বলেছিঝড়-বৃষ্টি যখন হচ্ছিল, তখন আমি বারান্দায় বসা। আকাশে বিজলি চমকাচ্ছে, তাই দেখছি। হঠাৎ শুনলাম তোমার আপা বলছে–কে কে? কথা শুনে মনে। হলো ভয় পেয়েছে। ব্যাপার কী দেখার জন্যে আমি টর্চলাইট নিয়ে গেলাম–জানালা দিয়ে টর্চ ফেললাম। দেখি কিছু না। তিনি তার ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছেন। আমি চলে এসেছি। তখন যদি জানতাম এমন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেছে, তাহলে…
দেখলেন সত্যি কথাকে সামান্য এদিক-ওদিক করলে কী হয়? সত্যিকে এদিক-ওদিক করলে বিরাট উলট-পালট হয়ে যায়। মিথ্যার বেলায় তা হয় না।
যে কথা বলছিলাম, আমার বাড়িটা হয়ে গেল কান্না বাড়ি। কখনো রূপা কাদছে, কখনো ছোটন কাঁদছে এবং কখনো দেখা যাচ্ছে দু’জনই কাঁদছে। কান্না যখন থামছে তখন হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। ইনহেলার হাতে নিয়ে দু’বোন পাশাপাশি বসা। দু’জনই বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। একজনের হাতে ইনহেলার। ইনহেলারটা গাজার কল্কের মতো হাতবদল হচ্ছে। অসম্ভব বিরক্তিকর ব্যাপার।
এই ধারাবাহিক কান্নাকাটির জন্যে আমার একটা ক্ষতিও হয়ে গেল। কাঁসাকন্যা উধাও হয়ে গেল। তার কথাবার্তা শোনা যায় না। তাকে দেখতে পাওয়া তো আরো দূরের ব্যাপার। কাঁসা-কন্যার গলার শব্দ শোনার জন্যে আমি অনেক চেষ্টা চালালাম। দীর্ঘ সময় ছাদে বই নিয়ে বসে রইলাম। সারাক্ষণ অপেক্ষা করলাম এই বুঝি কাচের চুড়ির টুনটন শব্দ শুনব। কাঁসা-কন্যা বলে উঠবে, এখানে একা একা কী করেন?
কাঁসা-কন্যার সঙ্গে কথা বলার তীব্র বাসনা আমার মধ্যে তৈরি হলো। তাকে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। তার মধ্যে একটি হলো–সাথীর মৃত্যু সে কীভাবে দেখছে? আমি জানি তাকে জিজ্ঞেস করার অর্থ নিজেকেই জিজ্ঞেস করা। সে জবাব যা দেবে তা আমারই জবাব। সেই জবাবও আমার জানা দরকার। আমি কথা বলতে চাই আমার সাব-কনশাস মনের সঙ্গে। সেটা তো এমনিতে সম্ভব না। অবচেতন মনের সঙ্গে কথা বলার জন্যে আমার অবশ্যই কাঁসা-কন্যাকে প্রয়োজন। এ বাড়ির কান্না বন্ধ না হলে সে হয়তো আসবে না।
আমি কান্না বন্ধ করার ব্যবস্থা করলাম। দু’বোনের যে-কোনো একজনের কান্না বন্ধ হলে অন্যজনেরটা বন্ধ হবে। আমি বেছে নিলাম ছোটনকে। ঠিক করলাম তাকে ছোটখাটো একটা শক দেয়া হবে। তার মন’ নামক বিষয়টাকে নাড়া দেয়া হবে। এমন এক ধরনের নাড়া যার জন্যে সে মোটেই প্রস্তুত না। সে পুরোপুরি হকচকিয়ে যাবে। মাথা যাবে এলোমেলো হয়ে। আমি এক সন্ধ্যায় তাকে ছাদে ডেকে পাঠালাম।
সে ছাদে উঠে এলো। তার মুখ বিষণ্ণ। চোখ লাল। বোঝাই যাচ্ছে ছাদে উঠে আসার আগে আগে সে চোখ মুছেছে।
আমি কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ ছোটন?
ভালো আছি।
এটা কি ভালো থাকার নমুনা? চোখে এখনো পানি।
ছোটন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, দুলাভাই, আমি ভালো নেই। আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ছোটন, শোন, আমি নিজেও ভালো নেই। আমারও মরে যেতে ইচ্ছা করছে। আমি প্রায়ই ছাদে উঠে আসি, যাতে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যেতে পারি। আমার সাহস কম বলে কাজটা করতে পারছি না।
ছোটন খুবই বিস্মিত হয়ে বলল, আপনার কী হয়েছে?
আমি বললাম, আমার কী হয়েছে আমি তোমাকে বলছি, তার আগে। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি–তুমি কি জানো আমি ভয়ঙ্কর একজন মানুষ?
না তো।
আমার যে মাথা খারাপ এটা তুমি জানো না? তোমার আপা তোমাকে কিছু বলে নি?
আপনার মাথা খারাপ এটা বলে নি। আপনি মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করেন এটা বলেছে।
তোমাকে বলে নি সে আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল?
হ্যাঁ বলেছে।
কোনো ভালো মানুষকে নিশ্চয়ই কেউ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায় না?
আপনি সামান্য একসেনট্রিক। আপা অল্পতেই ভয় পায় বলে আপনাকে নিয়ে গেছে। মানুষ হিসেবে আপনি স্বাভাবিক।