আর শেখাব না।
অ্যাপার্টমেন্ট হাউস খুঁজে দিতে বলেছি, দয়া করে খুঁজে দিন। এই বাড়িতে তিন-চার দিনের বেশি আমি থাকতে পারব না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমি বললাম, আমার সঙ্গে শেষপর্যন্ত বিয়ে না হয়ে তাহলে ভালোই হয়েছে। বিয়ে হলে দমবন্ধ অবস্থায় জীবন কাটাতে হতো।
সাথী কঠিন গলায় বলল, আপনার-আমার বিয়ের প্রসঙ্গটা আপনি আর কখনো তুলবেন না। কখনো না।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
আপনি আপনার মতো থাকবেন। আমরা দু’বোন থাকব আমাদের মতো। আমরা আপনাকে বিরক্ত করব না। দয়া করে আপনিও আমাদের বিরক্ত করবেন না।
আমি বিনীতভাবে বললাম, জি আচ্ছা।
সাথী বলল, আমরা আমাদের মতো করে খেয়ে নেব। সবাই এক সঙ্গে বসে খাওয়া–এইসব ফর্মালিটির মধ্যে আমাদের টানবেন না। প্লিজ।
জি আচ্ছা।
সাথী আমার ‘জি আচ্ছা’ বলা শেষ করার আগেই হুট করে উঠে চলে গেল। ঠিক তখনি আমার মনে হলো এডগার এলেন পো’র THE END খেলাটা এই কঠিন মহিলার সঙ্গে খেলা যেতে পারে।
আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু না। আমার মাথায় খুনের কোনো পরিকল্পনা ঘুরছিল না। আমি ছোট্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চাচ্ছিলাম, সাথী নামের আমার হলেও হতে পারত স্ত্রীকে মানসিক একটা ধাক্কা দিয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম কী হয়। সে এখন এমনিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় ছোট্ট ধাক্কাই কাজ করে। গভীর রাতে হঠাৎ তার চোখে তীব্র আলো ফেলা। ভয়টাকে আরো জমানোর জন্যে আমাকে এক জোড়া চটিজুতা জোগাড় করতে হবে। চটিতে ফটফট শব্দ করতে করতে তাদের ঘরের জানালার সামনে দাঁড়াব। খুব সাবধানে জানালার পর্দা সরিয়ে তার মুখে পাঁচ ব্যাটারির টর্চের তীব্র আলো ফেলে আবার চটির ফটফট শব্দ করে চলে আসব।
এই কাজটার জন্যে বিশেষ একটা রাত বের করতে হবে। ঝড়-বৃষ্টির রাত, যে রাতে ইলেকট্রিসিটি থাকবে না। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো বৃষ্টির শব্দ হতে থাকবে।
আমি এক্সপেরিমেন্টটা করি মে মাসের উনিশ তারিখ রাত দু’টায়। রাতটা ছিল ঝড়-বৃষ্টির। এক্সপেরিমেন্টের জন্যে রাতটা শুভ ছিল না। কারণ ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বিদ্যুৎ চমকানোর কারণে চোখে আলো পড়লে সেই আলোটা স্বাভাবিক মনে হবে। মনে হবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভয়টা সে-রকম লাগবে না।
আমি সে-কারণেই টর্চের মুখে লাল কাগজ লাগিয়ে আলোটাকে লাল করে ফেললাম।
যথাসময়ে আলো ফেলা হলো। যে-রকম হবে ভেবেছিলাম সে-রকম হলো। সাথী ক্ষীণ স্বরে একবার বলল, কে? তারপরে গোঙানির মতো আওয়াজ করে চুপ করে গেল। আমি হতাশ হয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। তখনো বুঝতে পারি নি সাথী মারা গেছে।
আমাকে খুনি বলছেন কেন
আমাকে খুনি বলছেন কেন?
আমি খুন করি নি। খুন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি সামান্য ভয় দেখিয়েছি। আমাদের সমাজে ভয় দেখানো নিষিদ্ধ না। আমরা সবসময় কাউকে না কাউকে ভয় দেখাচ্ছি। আপনি আপনার নিজের কথা চিন্তা করুন। আপনি নিশ্চয়ই আপনার এক জীবনে অনেককে ভয় দেখিয়েছেন। কাউকে না কাউকে নিশ্চয়ই বলেছেন–জানে মেরে ফেলব, বদমাশ কোথাকার! ভূত সেজে কাউকে ভয় দেখান নি? অবশ্যই দেখিয়েছেন। আপনার ভয় দেখানোতে কেউ মারা যায়। নি। আমার ক্ষেত্রে একজন দুর্বল হার্টের কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে মারা গেছে। এতেই আমি খুনি হয়ে গেলাম? আপনার হিসাব-নিকাশ তো অদ্ভুত!
উনিশ শ’ একাত্তর সনের একটা গল্প বলি। মুক্তিবাহিনী ইন্ডিয়ান আর্মি নিয়ে আমাদের গ্রামে ঢুকেছে। রশীদ মণ্ডল নামের নিতান্তই নিরীহ একজনের সঙ্গে তাদের দেখা। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার কী মনে করে রশীদ মণ্ডলের হাত চেপে ধরে বলল, এই তুই কি রাজাকার?
সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল করে রশীদ মণ্ডল মারা গেল। এখন আমরা কি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারকে খুনি বলব? মানুষ খুন করার দায়ে আদালতে কি তার বিচার হবে?
তবে একটা কথা ঠিক যে, মানুষকে বিচার করা উচিত তার কর্মের পেছনের উদ্দেশ্য দিয়ে। কর্ম দিয়ে নয়। উদ্দেশ্য যদি হয় ভয় দেখিয়ে মজা করা, তাহলে কোনো অপরাধ হবে না। কিন্তু উদ্দেশ্য যদি হয় ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলা, তাহলে অবশ্যই অপরাধ হবে।
ভয় দেখিয়ে সাথীকে মেরে ফেলব–এরকম উদ্দেশ্য আমার ছিল না। এই ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই অপরাধী না, তবে তার ছোটবোনের মৃত্যুর জন্যে আমাকে দায়ী করতে পারেন। কোনো প্রমাণ অবশ্যি নেই। আদালত আমাকে দোষী প্রমাণ করে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারবে না। তবে আমি দোষী ঠিকই। দ্বিতীয় মৃত্যুটা অবশ্যই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
আচ্ছা ভাই, আপনি এত অস্থির হয়ে পড়েছেন কেন? ঠাণ্ডা মাথায় আগে গল্পটা শুনুন। একজন সিজিওফ্রেনিক রোগী খোলামেলাভাবে তার গল্প বলছে। আপনার তো উচিত মন দিয়ে শোনা। আপনি একজন লেখক মানুষ। লেখকরা। গল্প খুঁজে বেড়ায়, সেখানে আপনাকে কোনো খোঁজাখুঁজি করতে হয় নি। আমি নিজেই গল্প নিয়ে উপস্থিত হয়েছি। মানুষ খুব সহজ প্রাণী’–এরকম কেন ভাবছেন? কেন ভাবছেন মানুষের মস্তিষ্ক শূন্য আকাশের মতো নির্মল?
‘সাধু সাধু সাধু’ রবে কাঁপে চারিধার–
সবে বলে, পরিষ্কার অতি পরিষ্কার’!
দুর্বোধ্য যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল,
শূন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল!
কার কবিতা বলুন তো? ঠিক ধরেছেন–রবীন্দ্রনাথের ‘হিং টিং ছট’। কবিতাটা কখন লেখা হয়েছে, কোথায় লেখা হয়েছে, বলতে পারবেন?
পারবেন না। কারণ আপনি আমার মতো খুঁটিয়ে পড়েন না। বেশিরভাগ মানুষই পড়ে না। বেশিরভাগ মানুষ জলের উপর উড়াউড়ি করে। জল স্পর্শ করে না। আমি করি। হিং টিং ছট’ কবিতাটা লেখা হয়েছে শান্তিনিকেতনে। প্রচণ্ড গরমের সময় জ্যৈষ্ঠ মাসে। বাইরের উত্তাপ তাঁর কবিতাতেও চলে এসেছে—