আমরা এই ঘটনাটাকে বলতে পারি ‘চটি ভূতের উপদ্রব। তিন বোনের কাছে চটি ভূত এত ভয়ঙ্কর কেন তা জানতে হলে তার বাবার মৃত্যুর সময়ের কথাটা বলতে হয়। ভদ্রলোক শ্বাসকষ্ট এবং বুকের ব্যথায় ছটফট করছিলেন। মেয়েরা ছোটাছুটি করছিল কীভাবে ডাক্তারের কাছে বাবাকে নিয়ে যাওয়া যায় সেই বুদ্ধি বের করার জন্যে। তাদের বাসার টেলিফোন কাজ করছিল না। তারা পর্যায়ক্রমে ছুটে দোতলার বারান্দায় যাচ্ছিল যদি সেখান থেকে কোনো রিকশা বা বেবিট্যাক্সি দেখা যায়। অন্য সময় সারারাতেই তাদের বাড়ির সামনে রিকশা বা বেবিটেক্সি দেখা যায়। সেই রাতে কিছুই ছিল না।
এমন অবস্থায় সোবাহান সাহেবের বুকের ব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে গেল। তিনি সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, পানি খাব। ঠাণ্ডা পানি।
রূপা দৌড়ে পানি নিয়ে এলো। তিনি পানির গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, আধা গ্লাস পানি এনেছিস কী করে? পুরো গ্লাস আন। তৃষ্ণা পেয়েছে।
রূপা গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে এলো। তিনি এক চুমুকে তৃপ্তি নিয়ে পানি শেষ করে বললেন, বাথরুমে যাব। চটিজুতা জোড়া আন।
চটিজুতা জোড়া খুঁজে পাওয়া গেল না। তাঁর ছোট মেয়েটা স্পঞ্জের স্যান্ডেল এনে দিয়ে বলল, চটি পাওয়া যাচ্ছে না, স্পঞ্জের স্যান্ডেল পর।
সোবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, চটিজুতা জোড়া যাবে কোথায়? ঘরেই আছে, খুঁজে বের কর।
তিন বোন ব্যাকুল হয়ে চটিজুতা খুঁজতে লাগল। তিনি কিছুক্ষণ পর পর খোঁজ নিচ্ছেন–এই, পাওয়া গেছে? আমার যে বাথরুমে যেতে হবে ভুলে। গেছিস! তিন ধুমসি মিলে করছিস কী? চটি জোড়া খুঁজে বের করতে পারছিস না?
সাথী এসে কোমল গলায় বলল, বাবা, তোমার শরীরটা খারাপ। এইভাবে চিৎকার করবে না।
আমার বাথরুমে যেতে হবে না? আমি কি বিছানায় হেগে দেব? তোরা তাই চাস?
স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পরে যাও বাবা।
অবশ্যই আমি স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরব না। তোরা যেখান থেকে পারিস চটি জোড়া খুঁজে আন। প্রয়োজনে আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্যকে দিয়ে আমার চটি এনে দিবি। তিন ধুমসি, কাজ নেই কর্ম নেই, শুধু গুটুর গুটুর, শুধু রঙ-তামাশা। রঙ-তামাশা অনেক সহ্য করেছি, আর না…
এই বলে চিৎকার করতে করতেই তাঁর স্ট্রোক হলো। Cerebral Stroke. সেই স্ট্রোকেই মৃত্যু।
সেরিব্রেল স্ট্রোকের বাংলা জানেন? বাংলা হলো ‘সন্ন্যাস রোগ’। সন্ন্যাসীরা কী করে? তারা তাদের অতি প্রিয় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, আর ফিরে আসে না। সন্ন্যাস রোগে প্রাণবায়ু তার ঘর অর্থাৎ তার শরীর ছেড়ে চলে যায়। আর ফিরে। আসে না।
কী বলতে কী বলছি, মূল অংশে আসি। রূপার বাবা চটি চটি’ করতে করতে মারা গেলেন। মৃত্যুর পর পরই চটি পায়ে তার হাঁটার শব্দ শোনা যেতে লাগল। তিন বোনই শুনল। চটর চটর শব্দ হচ্ছে। এই তিনি যাচ্ছেন বাথরুমের দিকে, এই গেলেন বারান্দায়। চটির শব্দের সঙ্গে তাঁর খুকখুক কাশিও কয়েকবার শোনা গেল। ভয় এবং তীব্র আতঙ্কে তিন বোনই জমে গেল। মৃত্যুশোকের বদলে তাদের গ্রাস করল তীব্র ভয়।
আপনি কি বুঝতে পারছেন চটির শব্দ শোনার পেছনে কাজ করছে–মানসিক অবসাদ এবং তীব্র ঘোর? মানুষের আত্মা (যদি থেকে থাকে) নিশ্চয়ই চটি পায়ে হাঁটাহাঁটি করবে না। সোবাহান সাহেব যদি মরে ভূত হয়েও থাকেন তারপরেও সেই ভূত নিশ্চয়ই তার তিন অসহায় মেয়েকে ভয় দেখাবে না। এটা হলো সাধারণ যুক্তি। ভয় যুক্তি মানে না–তিন বোন তাদের ভূত-পিতার ভয়েই অস্থির হয়ে আমার বাড়িতে উঠে এলো।
আমি যথেষ্টই বিরক্ত হলাম। একা থেকে আমার অভ্যাস। আমার কোনো কাজের লোকেরই যেখানে দোতলায় আসার হুকুম নেই, সেখানে তিন কন্যা দোতলায় বাস করবে–এটা মেনে নেয়া আমার জন্যে খুব কঠিন। তারপরেও আমি তাদের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করলাম। সাথী বিব্রত গলায় বলল, কয়েকটা দিন শুধু থাকা।
আমি বললাম, আপনার যত দিন থাকতে ইচ্ছা হয় থাকবেন। কোনো সমস্যা নেই।
সাথী বলল, আপনার সমস্যা না থাকতে পারে, আমার সমস্যা আছে। আমি কেন বোনের স্বামীর বাড়িতে বাস করব?
আমি বললাম, সমস্যায় পড়েছেন বলে বাস করছেন। শখ করে তো থাকছেন না।
সাথী বলল, আপনার তো অনেক লোকজন আছে, আপনি তাদেরকে বলেন আমাকে দু’রুমের ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে দিতে। আমি ছোটনকে নিয়ে সেখানে থাকব।
নিজের বাড়িতে যাবেন না?
না।
চটির ফটফট শব্দ শুনবেন বলে ভয় পাচ্ছেন?
সাথী রাগী গলায় বলল, যে ঘটনা ঘটেছে সেটা নিয়ে দয়া করে হাসিতামাশা করবেন না। আমি হাসি-তামাশা পছন্দ করি না। আমার সেন্স অব হিউমার নিম্ন পর্যায়ের।
আমি বললাম, আপনার লজিক সেন্স অব হিউমারের চেয়েও নিম্ন পর্যায়ের।
তার মানে কী? আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?
আমি শান্ত গলায় বললাম, অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে উঠে কিন্তু আপনি চটির শব্দ থেকে বাঁচতে পারবেন না। চটির শব্দ আপনার পেছনে পেছনে সেখানেও উপস্থিত হবে। কারণ চটির শব্দটা হয় আপনার মস্তিষ্কে। কেউ চটি পরে আপনাকে ভয় দেখায় না। আমার ধারণা এই বাড়িতেও আপনারা চটির শব্দ শুনবেন। হয়তো আজ রাতেই শুনবেন।
সাথী অসম্ভব বিরক্ত গলায় বলল, জ্ঞানী জ্ঞানী কথা আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে করবেন। সে জ্ঞানী কথা শুনতে পছন্দ করে। আমি করি না। আর আপনি আরেকটা কথা ভুলে যাচ্ছেন। কথাটা হলো আমি একজন ডাক্তার। যে মানসিক কারণ আপনি বলছেন সেই কারণ আমি জানি। আমাকে শেখাতে হবে না।