চাই।
আমি বড় হয়েছি কান্নার শব্দে। আমার মা নানাবিধ দুঃখ-কষ্টে সবসময় কাঁদতেন। আমার দু’বোন কাঁদত। যখন বাবা নেশা করতেন তিনিও হো হো শব্দ করে কাঁদতেন। আমাদের বাড়িটা ছিল কান্নার বাড়ি। সেই বাড়িতে একজন শুধু হাসত।
সে কে?
আমার মেজ বোন। সে সব কিছুতেই হাসত।
আমার মতো?
হ্যাঁ, তোমার মতো। মেজ বোনের বয়স যখন দশ বছর, তখন সে বাবার উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। আর কোনোদিন ফিরে নি।
সে কী!
তুমি এতে চমকে উঠলে কেন? তুমি তো সবই জানো। আমি যা জানি তুমিও তা জানো।
আপনার সেই বোন এখন কোথায়?
জানি না কোথায়। সে হারিয়ে গেছে।
তাকে খোঁজার চেষ্টা করা হয় নি?
মানুষের পক্ষে সম্ভব সব চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা মাসের পর মাস এই ভেবে কাটিয়েছি যে সে ফিরে আসবে।
আপনি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। আর কথা বলবেন না। শুয়ে পড়ুন। পানি খাবেন? বরফ দেয়া ঠাণ্ডা পানি?
হ্যাঁ খাব।
আমি দরজার দিকে তাকিয়ে আছি আমি নিশ্চিত যে আজ সে যখন দরজার আড়াল থেকে বের হবে তখন তাকে দেখা যাবে। কল্পনা-কন্যা বাস্তবে রূপ নেবে।
যা ভেবেছি তাই হলো। আমি কাঁসা-কন্যাকে এক ঝলক দেখলাম। সে দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে দ্রুত পাশের ঘরে চলে গেল।
সে দেখতে কেমন?
রূপার মতো। আমার মস্তিষ্ক কল্পনায় অচেনা কোনো মেয়েকে তৈরি করে নি। অচেনা মেয়ে তৈরি করা তার জন্যে কষ্টকর হতো। সে চেনা একজনকেই তৈরি করেছে।
ভাই সাহেব, আমি আমার জীবন-গল্পের কঠিন একটা সময়ে চলে এসেছি। আমার জীবনে দু’টি বিশেষ ঘটনা এই সময় ঘটে।
এক. কাঁসা-কন্যাকে প্রথমবার কিছুক্ষণের জন্যে দেখতে পাই।
দুই. আমার শ্বশুরসাহেব মারা যান।
আমার শ্বশুরসাহেবের মৃত্যুর খবর অবশ্যি সেই রাতে পাই না। খবরটা আসে পরদিন ভোরে।
কোনো জামাইয়ের কাছেই তার শ্বশুরের মৃত্যু বিশেষ ঘটনা না। আমার কাছে বিশেষ ঘটনা, কারণ শ্বশুরসাহেবের মৃত্যুর পর রূপার দুই বোন বাস করার জন্যে আমার বাড়িতে উঠে এলো। ঐ বাড়িতে তারা থাকতে পারছিল না। ভয় পাচ্ছিল।
আপনি কি এডগার এলেন পো’র নাম শুনেছেন? আমেরিকান কবি ও গদ্যকার। তাঁর মূল আগ্রহ ছিল Supernatural-এর দিকে। বিখ্যাত সব ভূতের গল্প লিখেছেন। তাঁর অনেক গল্প নিয়ে সুন্দর সুন্দর ছবিও হয়েছে। ঢাকায় এসেছে Pit and the pendulum. উনার গল্প ঠিকঠাক পরিবেশে পড়লে ‘ঘুম খতম পয়সা হজম হয়ে যাবে।
অদ্ভুত অদ্ভুত কায়দায় খুনের বর্ণনা তার লেখায় পাওয়া যায়। একটা খুন কীভাবে করা হয় তার সামারি এন্ড সাবসটেন্স আপনাকে বলি। অসুস্থ বৃদ্ধ একজন মানুষ। রোজ গভীর রাতে খুব সাবধানে তার ঘরের দরজা খোলা হয়। বৃদ্ধের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। বৃদ্ধ দেখতে পান। তাঁর ঘরের দরজা সামান্য ফাঁক হলো। তিনি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেন–কে কে? কেউ জবাব দেয় না। বৃদ্ধের ভয় তুঙ্গস্পর্শী হয়, তিনি থরথর করে কাঁপতে। থাকেন। এই পর্যায়ে খোলা দরজার ফাক দিয়ে তাঁর চোখে ফেলা হয় লণ্ঠনের আলো। বৃদ্ধ মারা যায় চোখে হঠাৎ আলো পড়ার ভয়ে এবং অস্বাভাবিক উত্তেজনায়।
অল্প যে কয়টি ভূতের গল্প আমাকে অভিভূত করেছে–এলেন পো’র এই গল্প তার একটি। আমি সবচেয়ে বেশিবার সম্ভবত এই গল্পটিই পড়েছি। গল্পটি আমাকে এত অভিভূত কেন করেছে তার কারণটা বলি। এই গল্প পড়েই প্রথম বুঝতে পারি মৃত্যু খুবই সহজ ব্যাপার। একটি মানুষকে খুন করার জন্যে ছুরিকঁচি, বন্দুক কিছুই লাগে না। কায়দামতো সামান্য ভয় দেখাতে পারলেই হয়।
তবে গল্পের মৃত্যু এবং বাস্তবের মৃত্যু একরকম নাও হতে পারে। চোখে আলো ফেলে গল্পে হয়তোবা একজনকে মারা সম্ভব। বাস্তবে কি সম্ভব? আমি ঠিক করলাম ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখব। আমি চোখে আলো ফেলবার জন্যে পাঁচ ব্যাটারির একটা টর্চ কিনলাম।
আরে না না, এখনকার কথা বলছি না। সাত-আট বছর আগের কথা বলছি। আমার মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রবণতা আছে। সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করলে আমি হয়তোবা ভালো সায়েন্টিস্ট হতাম। দুঃখের ব্যাপার হলো, আমি এমন বিষয়ে পড়াশোনা করেছি যেখানে হাতে-কলমে গবেষণার সুযোগ নেই।
আমার পড়াশোনার বিষয় দর্শন। এই বিষয়টা এমন যে এর সাহায্যে ঈশ্বর আছেন এই বিষয়ে একশ’ প্রমাণ দেয়া যায়, আবার ঈশ্বর নেই এই বিষয়ে একশ’ প্রমাণ দেয়া যায়। খুবই মজার ব্যাপার।
শুধুমাত্র চোখে আলো ফেলে ‘THE END’ খেলাটা আমি খেলতে পারি নি, কারণ আমাদের বাড়িতে গুরুতর অসুস্থ কেউ ছিল না। গুরুতর কেন, মোটামুটি অসুস্থও কেউ নেই। এই বাড়িতে সুস্থ-সবল লোকজন বাস করে।
রূপার দুই বোন যখন থাকতে এলো তখন হঠাৎ করে মনে হলো–মন্দ না। THE END-খেলা খেলা যেতে পারে। এই দুই বোন অসুস্থ না, খুবই সুস্থ; তবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বাবার মৃত্যু তারা নিতেই পারছে না। তাদের দেখে মনে হচ্ছে তাদের জগৎ-সংসার কপূরের মতো উড়ে গেছে। তারা এখন আর মানুষের পর্যায়ে নেই, জম্বি পর্যায়ে।
জম্বি চেনেন তো? জম্বি হলো মৃত মানুষ যারা জীবিতদের মতো জীবনযাপন করে। জিন্দালাশ বলতে পারেন। আমার বাড়িতে থাকতে এসে তারা খুবই বিব্রত বোধ করতে লাগল। বিশেষ করে রূপার বড় বোন সাথী। তারা তাদের নিজের বাড়িতে থাকতে পারছিল না। সেখানে নানান সমস্যা। সন্ধ্যা। মিলাবার পরপরই না-কি চটি ফটফট করে কে হাঁটে। মাঝে মাঝে দরজার কাছাকাছি এসে চটির শব্দ থেমে যায়। দরজা খুললে দেখা যায় কেউ নেই।