রূপার সঙ্গে আমি অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। এক রাতের জন্যে সে নেই, আমার মনে হলো–এ কী! আমি কোথায়? নিজের বাড়িটাও আমার কাছে অচেনা মনে হতে লাগল। রাত একটার পর থেকে ভয় ভয় করতে লাগল। মনে হলো লাইব্রেরি ঘরে কে যেন হাটছে, বই নাড়াচাড়া করছে।
বারান্দার চেয়ার ধরে টানাটানির শব্দ পেলাম। এই শব্দটা স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে বানরগুলি বারান্দায় চলে এসে চেয়ার টানাটানি করে। তবে তখন তাদের কিচকিচ শব্দ শোনা যায়। এখন কোনো কিচকিচ শব্দ শোনা যাচ্ছে না। একবার মনে হলো–বারান্দায় গিয়ে দেখে আসি ঘটনা কী। সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, যদি দেখি কিছুই নেই, বারান্দা শূন্য, তাহলে ভয় পাব। এরচে’ না দেখাই ভালো।
ভূতের ভয় কাটানোর দুটি পদ্ধতি আছে। দু’টি পদ্ধতির একটি হলো, সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যাওয়া। নগ্ন হয়ে হাঁটাহাঁটি করা। যে ভূতের ভয়ে অস্থির হয়ে আছে, নগ্ন হওয়া মাত্র তার সব ভয় কেটে যাবে। নগ্ন হবার কারণে তার ভেতরে প্রবল লজ্জার বোধ তৈরি হবে। লজ্জাবোধ, ভয়বোধকে কাটিয়ে দেবে। অনেকটা মেটার এন্টিমেটারের এনিহিলেশনের মতো।
ভয় কাটানোর দ্বিতীয় উপায় হলো, ভূতের বই পড়তে শুরু করা। বিষে। বিষক্ষয়।
আমি রাতের খাওয়া শেষ করে একটা ভূতের বই হাতে নিয়ে বিছানায় গেলাম। পাতা খুলে পড়তে শুরু করেছি, তখনি শুনলাম পাশের ঘরে চামচের শব্দ। কেউ যেন চা বানাচ্ছে। এই একটা কাপে চামচ নাড়ল, এই সে দ্বিতীয় কাপে চামচ নাড়ছে। চা সম্ভবত দু’কাপ বানানো হচ্ছে।
এমন কি হতে পারে যে কাজটা বানর করছে? বানর অনুকরণ করতে খুবই ভালোবাসে। সে রূপাকে চা বানাতে দেখেছে। এখন অনুকরণ করছে। বানরের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বাতিল করতে হলো। কারণ বানরের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্যে পুরো বাড়ি নেট দিয়ে ঘেরা। শুধু বারান্দার একটা অংশ খালি। যেখানে আমি বানরের সঙ্গে কথা বলি।
তাহলে চামচ কে নাড়ছে? আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে? পুরাতন ব্যাধি মাথাচাড়া দিচ্ছে? হেলুসিনেশন কোনো ব্যাধি না, হেলুসিনেশন হলো আধি। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে—
‘ব্যাধির চেয়ে আধি হলো বড়’
ব্যাধি শরীরের রোগ। আধি মনের রোগ। আমাকে কোনো ব্যাধিতে ধরে নি, আমাকে ধরেছে আধিতে। শরীরের ব্যাধিকে উপেক্ষা করে সে ব্যাধি সারানো যায় না। টাইফয়েড হলে ক্লোরোমাইসিটিন লাগবে। নিউমোনিয়া হলে পেনিসিলিন নিতে হবে। মনের আধিকে হয়তো উপেক্ষা করে সারানো যায়। আমি চায়ের কাপের চামচের শব্দ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলাম–বই পড়তে শুরু করলাম। লেখক যথেষ্ট জমাট ভূতের গল্প ফেঁদেছেন। পরিবেশ সুন্দর তৈরি করেছেন।
একজন যাত্রী দূরপাল্লার ট্রেনে যাচ্ছেন। প্রথম শ্রেণীর কামরায় তিনি একা। রাত এগারোটার মতো বাজে। শীতের রাত। ভালো শীত পড়েছে। বাইরে ঘন কুয়াশা। জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তারপরেও তিনি দীর্ঘ সময় জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। একা একা তিনি ‘বোর হচ্ছিলেন। ব্যাগ খুলে হুইস্কির বোতল খুলে নির্জলা হুইস্কি এক সঙ্গে অনেকখানি খেয়ে ফেললেন। তার ভালো নেশা হয়ে গেল। শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল। ঘুমও পেল। কম্বল গায়ে জড়িয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন। ট্রেনের ঝাকুনিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড শীতে। তিনি দেখলেন ট্রেনের কামরার প্রতিটি জানালা খোলা। জানালা দিয়ে হু-হু করে বরফের মতো ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। অবাক হয়ে দেখলেন…
গল্পের এই পর্যায়ে আমার ঘরের দরজার পাশে খুট করে শব্দ হলো। আমি বললাম, কে?
দরজার আড়াল থেকে অবিকল রূপার গলায় কেউ একজন বলল, আপনার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। চা খেয়ে আসুন।
আমি হাতের বই রাখলাম। পাশের ঘরে গেলাম। সেখানে সত্যি সত্যি পিরিচে ঢাকা চা। আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলাম। চায়ে চুমুক দিলাম। দরজার আড়াল থেকে নারীকণ্ঠ বলল, চায়ে চিনি হয়েছে?
আমি বললাম, হয়েছে। তুমি কি কাঁসা-কন্যা?
(হাসি)
দরজার আড়ালে কেন? সামনে আস।
(হাসি।) (চুড়ির টুনটুন শব্দ।)।
কাঁসা-কন্যা, তুমি কি জানো যে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই? তুমি হচ্ছ আমার কল্পনা।
জানি না।
আমার ভয়ঙ্কর একটা রোগ হয়েছে। রোগটার নাম আধি।
আধি আবার কেমন রোগ? মনের রোগ। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে—
বিনুর বয়স তেইশ তখন, রোগে ধরল তারে।
ঔষধে ডাক্তারে
ব্যাধির চেয়ে আধি হল বড়;
নানা ছাপের জমল শিশি, নানা মাপের কৌটো হল জড়ো।
রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছ?
শুনেছি।
তা তো শুনবেই। আমি যা যা জানি, তুমিও তা জানো। আমার সমস্ত জ্ঞানই তোমার মধ্যে আছে।
তাহলে আধি কী জানলাম না কেন?
তারও ব্যাখ্যা আছে–তোমাকে পুরোপুরি আমার মতো করে তৈরি করলে খেলাটা জমে না। খেলা জমানোর জন্যে এটা করা হয়েছে। তোমাকে সামান্য অন্যরকম করা হয়েছে। যাতে আমাকে বিভ্রান্ত করা যায়।
কে আপনাকে বিভ্রান্ত করছে?
আমিই আমাকে বিভ্রান্ত করছি। সাপ হয়ে দংশন করছি, আবার ওঝা হয়ে ঝাড়ছি।
(হাসি)
হাসছ কেন?
(আবারো হাসি)
তুমি যে মিষ্টি করে একটু পরপর হেসে উঠছ তারও কিন্তু ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাটা হলো–কেউ হাসলে আমার ভালো লাগে। কেউ কাঁদলে কিংবা মন। খারাপ করে থাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তখন ইচ্ছা করে যে কাঁদছে তাকে আরো কাঁদিয়ে দেই। আমি এরকম কেন হয়েছি–শুনতে চাও?