সাথী আপার স্বভাব হচ্ছে সে চট করে রেগে যায়। যদি রেগে যায়, তুমি কিছু মনে করো না।
উনি রেগে যাবেন সে-রকম কিছু কি আমি করেছি?
না, করো নি। কিন্তু আপার রাগের কোনো ঠিক নেই।
উনি যদি রাগারাগি করেনও আমি কিছুই মনে করব না। শান্ত ভঙ্গিতে তার কথা শুনব।
উনি উনি করছ কেন?
তোমার বড় বোন, আমি উনি উনি করব না?
দস্তা-কন্যা ক্ষীণ গলায় বলল, কী আশ্চর্য ঘটনা, তার সঙ্গে বিয়ে হলে সে…
দস্তা কথা শেষ করল না। মাঝপথে থেমে গেল। আমি বললাম, উনার সঙ্গে কথা কি টেলিফোনে হবে? না-কি আমাকে তোমাদের বাড়িতে যেতে হবে?
দস্তা হড়বড় করে বলল, বাড়িতে যেতে হবে না। তুমি আমাদের বাড়িতে যেতে পছন্দ কর না, আমি জানি। টেলিফোনে কথা বললেই হবে।
বেশ, টেলিফোন ধরে দাও। আমি সুবোধ বালকের মতো কথা বলব।
এখন বলবে?
হ্যাঁ।
আপা কি হাসপাতালে না বাসায় তা তো জানি না। আচ্ছা দেখি। আপা উল্টাপাল্টা কিছু বললে প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না। আপা আমাদের দু’বোনের কাছে মায়ের মতো। ছোটনের জন্মের সময় আমার মা মারা যান। তখন আমার নিজের বয়স তিন বছর। আর আপার বয়স সাত বছর। এই সাত বছরের মেয়েই কিন্তু আমাদের দেখাশোনা করেছে। আপাকে যে আমরা কী পরিমাণ ভালোবাসি, কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করি, সেটা পৃথিবীর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব না। আমাদের কাছে আপা এক দিকে, আর সমস্ত পৃথিবী এক দিকে।
তাই না-কি?
হ্যাঁ তাই। আপা যদি আমাকে ডেকে বলে–তুই যা ছাদে ওঠ, তারপর ছাদ থেকে লাফ দিয়ে উঠানে পড়ে যা। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা করব।
তোমার আপা যদি বলে, একটা কাজ কর–গ্লাসে ইঁদুর মারা বিষ মিশিয়ে শরবত বানা। তারপর এই শরবত তোর স্বামীকে খেতে দে। তুমি দেবে?
দস্তা হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তার মনে হয় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে। হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কপালে ঘাম। আমি বললাম, তুমি এরকম ভাব করছ যেন সত্যি সত্যি তোমার আপা তোমাকে ইঁদুর মারা বিষের শরবত বানাতে বলেছে। সহজ হও তো।
দস্তা সহজ হবার চেষ্টা করতে করতেই টেলিফোন সেটের কাছে গেল। তার আপাকে সম্ভবত পাওয়া গেছে। দস্তা ইশারায় আমাকে ডাকছে।
আমি টেলিফোন রিসিভার হাতে নিয়ে নরম গলায় বললাম, কেমন আছেন?
সাথী সৌজন্যমূলক প্রশ্নের উত্তরের ধার দিয়েও গেল না। কঠিন গলায় বলল, আপনি আমার বোনকে দস্তা নামে ডাকেন কেন? এটা কোন ধরনের রসিকতা? দস্তা আবার কী?
আমি বললাম, আপনার তো বিয়ে হয় নি, সেই জন্যে আপনি জানেন না। স্বামীরা তাদের নবপরিণীতা স্ত্রীর সঙ্গে অনেক রহস্য করে। স্ত্রীর নাম পাল্টে তার পছন্দের নাম দেয়া একটা সাধারণ ব্যাপার।
সেই পছন্দের নাম দস্তা? আপনি কখনো তাকে দস্তা ডাকবেন না। কখনো না।
আচ্ছা এখন থেকে ডাকব না। এখন থেকে রূপা ডাকব।
আপনি রূপাকে আটকে রেখেছেন কেন?
আটকে রাখি নি তো।
অবশ্যই আটকে রেখেছেন। আটকে রেখেছেন বলে সে তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে আসতে পারছে না।
উনি অসুস্থ না-কি?
কী আশ্চর্য, আপনি জানেন না যে বাবা অসুস্থ?
না, আমি জানি না।
রূপা আপনাকে বলে নি?
না, বলে নি।
আপনাকে বলে নি কারণ সে জানে আমাদের বাবা অসুস্থ–এই খবরে আপনার কিছু যায় আসে না। আপনি আমার কথা শুনুন–আমার বোনকে আটকে রাখবেন না। তাকে এখুনি আমাদের বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। বাবার শরীর কতটা খারাপ তা আমি জানি। আমি একজন ডাক্তার।
এখন তো রাত অনেক হয়েছে।
যত রাতই হোক আপনি তাকে পাঠান। আপনার কোনো অধিকার নেই আমার বোনকে আটকে রাখার।
আমি তাকে পাঠাচ্ছি। কিন্তু আপনি ভুল করছেন–আমি তাকে আটকে রাখি। নি। কেন শুধু শুধু তাকে আটকে রাখব?
আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ। আপনার পক্ষে তাকে তালাবন্ধ করে রাখা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
আর কিছু বলবেন?
না, আর কিছু বলব না।
আমার একটা প্রশ্ন ছিল। অভয় দিলে প্রশ্নটা করি। আপনি যে-রকম রেগে আছেন প্রশ্ন করতে ভরসা পাচ্ছি না।
কী প্রশ্ন?
আপনারও কি রূপার মতো শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে? শ্বাসকষ্ট হলো। অনেকটা সাইকোসমেটিক ডিজিজ। যেহেতু আপনাদের তিন বোনের ভেতর অস্বাভাবিক মিল, সেহেতু সাইকোসমেটিক ডিজিজগুলিও তিনজনেরই হবার কথা।
আমার সঙ্গে জ্ঞান কপচাবেন না।
সাথী খট করে টেলিফোন রেখে দিল। আমি দস্তা-কন্যার দিকে তাকিয়ে। বললাম, রূপা, বাবাকে দেখতে যাবে, তৈরি হও।
দস্তা-কন্যা অবাক হয়ে বলল, তুমি আমাকে রূপা ডাকছ কেন? তুমি রূপা ডাকবে না। তুমি দস্তা ডাকবে।
গাড়িতে করে রূপাকে একাই তাদের বাড়িতে পাঠালাম। সে এমন ভাব করতে লাগল যেন দীর্ঘদিনের জন্যে বহুদূর দেশে যাচ্ছে। সম্ভাবনা এরকম যে আর ফিরবে না। তার চোখে অশ্রুবিন্দুও দেখা গেল। সে ধরা গলায় বলল, আমি কিন্তু রাতে থাকব না। আমি ফিরে আসব। তুমি ঘুমুবে না। তুমি অবশ্যই জেগে থাকবে। অবশ্যই আমার জন্যে অপেক্ষা করবে।
আমি বললাম, আমি অপেক্ষা করব। কিন্তু রূপা, তুমি কাঁদছ কেন?
রূপা চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোমাকে না বললাম আমাকে রূপা ডাকবে না? দস্তা ডাকবে।
রূপাকে নামিয়ে গাড়ি ফিরে এলো। জানা গেল, তার বোনরা তাকে রেখে দিয়েছে। রাতটা সে বোনদের সঙ্গে থাকবে।
মানুষ আর কিছু পারুক না-পারুক দ্রুত অভ্যস্ত হতে পারে। ট্যানারির পাশে যার বাসা, সে চামড়ার গন্ধে অভ্যস্থ হয়ে যায়। নির্মল আলো-বাতাসে তার সারাক্ষণ মনে হয়–জীবন থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কী যেন একটা চলে গেছে। রাতে ঘুম হয় না। ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়।