বলো কী?
অসুখ-বিসুখে যারা মারা যায় না তারা তাদের নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে।
তার মানে?
কেউ ঘুমের ওষুধ খায়, কেউ চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে বড় রাস্তায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে।
তুমি ঠাট্টা করছ। তুমি অবশ্যই ঠাট্টা করছ।
আমি ঠাট্টা করছি এরকম মনে হচ্ছে কেন?
তুমি হাসতে হাসতে কথা বলছ। হাসতে হাসতে কেউ এমন ভয়ঙ্কর কথা বলতে পারে না।
শোন দস্তা-কন্যা, সব মানুষ একরকম না। কাগজি লেবু গাছ সবই একরকম, কিন্তু প্রতিটি মানুষই আলাদা। আমি আলাদা। তুমি আলাদা।
হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে তুমি গাছে গরম বাতাস দিচ্ছ কেন?
প্রতিটি কাগজি লেবু গাছ একই রকম, তারপরেও এদেরকে মানুষের মতো আলাদা করা যায় কি-না সেই পরীক্ষা করছি। External stimuli দিয়ে পরিবর্তনটা করার চেষ্টা করছি।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি ঠিক সুস্থ না।
সুস্থতা ব্যাপারটা পুরোপুরি আপেক্ষিক। অনেকে হয়তো তোমাকেও অসুস্থ বলবে।
কেন? আমি কী করলাম?
এই যে তুমি সব কিছু ফেলে আমার সঙ্গে ট্যাগ হয়ে আছ, এটা অসুস্থতা? ছায়ার মতো আমার সঙ্গে লেগে আছ। অন্ধকারে ছায়া থাকে না। তুমি। অন্ধকারেও আছ।
তুমি কি আমার কাজে বিরক্ত হচ্ছ?
বিরক্ত হচ্ছি না। আবার পতিপ্রেম দেখে আনন্দে গদগদও হচ্ছি না। আমি সমান সমান আছি।
সমান সমান আছি মানে কী?
সমান সমান আছি মানে তোমার ছায়া-স্বভাব দেখে বিরক্ত হচ্ছি না, আবার খুশিও হচ্ছি না।
ফ্রিজের ভেতর কয়েকটা পলিথিনের প্যাকেট দেখলাম। প্যাকেটে কী?
প্যাকেটে রক্ত। মানুষের রক্ত। বি-পজিটিভ।
রক্ত ফ্রিজে রেখেছ কেন?
তুমি যা ভাবছ তা-না। রক্ত খাবার জন্যে রাখি নি। আমি ভ্যাম্পায়ার না। একটা অ্যাক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে রক্ত এনে রেখেছি।
গাছের গোড়ায় দেবে?
ঠিক ধরেছ। তোমার বুদ্ধি খারাপ না।
দস্তা-কন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই আছে। আমাদের বিয়ের সময় সে থাকতে পারে নি। সৌজন্য সাক্ষাতের জন্যে তার বাসায় একবার যাওয়া দরকার। তুমি কি যাবে?
আমি দস্তা-কন্যার চোখের দিকে তাকালাম। সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল। মনে হয় তার শ্বাসকষ্টও শুরু হলো। হালকাভাবে শাঁ শাঁ শব্দ শুনছি। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম দূরসম্পর্কের ভাই টাই কিছু না, দস্তা-কন্যা আমাকে কোনো একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে চাচ্ছে। আমি বললাম, কোনো অসুবিধা নেই। তুমি যেদিন বলবে সেদিনই তোমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসব।
উনি হয়তো উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করবেন, তাতে তুমি কিছু মনে করো না। উনার উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করা স্বভাব।
আমি কিছুই মনে করব না। উনার সব প্রশ্নের জবাব দেব।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
থ্যাংক য়্যু।
তোমার শ্বাসকষ্টটা কি কমেছে?
আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তুমি বুঝলে কী করে?
ভাব-ভঙ্গি দেখে বুঝলাম। তুমি যেমন আমার ভাব-ভঙ্গিতে বুঝে ফেললে আমাকে তোমার দূরসম্পর্কের ভাইয়ের বাসায় নেয়া দরকার, সে-রকম আর কী।
দস্তা-কন্যা হকচকিয়ে গেল। তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বুঝতে পারছি সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। সাইকিয়াট্রিস্টের ব্যাপারটা আমি ধরে ফেলব–এটা সে হয়তো ধারণা করে নি।
দস্তা-কন্যা ক্ষীণ গলায় বলল, চা খাবে?
আমি বললাম, হ্যাঁ খাব।
সে প্রায় ছুটে গেল চা আনতে।
দস্তা-কন্যার দূরসম্পর্কের ভাইয়ের সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছি। তার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। তিনি আমাকে ঘুমের ওষুধপত্রও দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে তো আপনাকে আগেই বলেছি। তাঁর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় দফায় আবার দেখা হয় তার গুলশানের চেম্বারে। সেটা আমার জন্যে খুবই ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতা। আপনাকে যথাসময়ে বলব। গল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চেষ্টা করছি, মনে হয় সে-রকম পারছি না। আপনি আমার এই অক্ষমতা নিজগুণে ক্ষমা করবেন। সবচে’ ভালো হতো যদি পুরো ব্যাপারটা আমি গুছিয়ে লিখে ফেলতে পারতাম। আমার লেখালেখি আসে না। দস্তা-কন্যার আবার লেখালেখি। খুব আসে। তাকে দেখছি প্রতি রাতেই টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কী যেন লিখে। এক রাতে এরকম লিখছে, আমি নিঃশব্দে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। শান্ত গলায় বললাম, কী লিখছ?
সে ঝট করে খাতা বন্ধ করে ভীত গলায় বলল, কিছু না।
আমি বললাম, কিছু না-টা কী? গল্প, উপন্যাস? গল্প, উপন্যাসের আরেক নাম–“কিছু না।
দস্তা জবাব দিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভয় পাচ্ছে–আমি বোধহয় তার কাছ থেকে খাতাটা কেড়ে নিয়ে নেব। আমি বললাম, ভয় পাচ্ছ কেন?
সে বলল, ভয় পাচ্ছি না তো।
আমি বললাম, তোমার যা ইচ্ছা তুমি লিখতে পার। আমি কখনো সেটা পড়ব না। তুমি বোধহয় জানো না, আমি সত্যবাদী।
আমি জানি তুমি সত্যবাদী।
কীভাবে জানো?
মানুষকে দেখে বুঝা যায়।
তাহলে খাতাটা বুকের সঙ্গে চেপে ভয়ে কাঁপছ কেন? তোমার যে অবস্থা কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে। সহজ হও তো।
দস্তা সঙ্গে সঙ্গে সহজ হয়ে গেল। হাসল। টেবিলের উপর খাতাটা রাখতে রাখতে বলল, তোমার যদি কখনো ইচ্ছা করে খাতায় কী লিখেছি তা পড়বে, তাহলে পড়তে পার।
আচ্ছা ঠিক আছে।
খাতায় যা লিখেছি সবই আমার নিজের মতামত লেখাটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না।
আচ্ছা নেব না।
সাথী আপা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল। তুমি কি কথা বলবে?
কেন বলব না? আমি যদি তোমার দূরসম্পর্কের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি–তোমার নিজের বোনের সঙ্গে কেন কথা বলব না!