দস্তা-কন্যা বলল, কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এসেছি। আসল কথাটা বলা হয় নি।
আসল কথা কোনটা?
ঐ যে তোমার যেমন ঘুম ভাঙলে ছাদে চলে যাওয়ার অভ্যাস আর আমার হলো ঘুম ভাঙলে কথা বলার অভ্যাস। সাথী আপার ঘুম খুব পাতলা তো–আমার ঘুম ভেঙে গেলে আমি বিছানায় উঠে বসতাম। সঙ্গে সঙ্গে সাথী আপা উঠে বসে বলত, তোর কী হয়েছে? শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না তো? আমি বলতাম, না। আপা এসো গল্প করি। তখন গল্প শুরু করতাম। এক সময় ছোটনকে ডেকে তুলতাম। ছোটন কে বুঝতে পারছ তো? আমার ছোট বোন। তখন শুরু হতো তিনজনের ম্যারাথন গল্প। আচ্ছা তুমি কি সাথী আপার উপর রাগ করে আছ?
রাগ করে থাকব কেন?
ঐ যে তোমাকে বিয়ে করে সরে গেল।
রাগ করি নি।
সাথী আপার ধারণা তুমি খুব রাগ করে আছ। এই জন্যেই সে এ বাড়িতে আসে না। যেহেতু সে আসে না, ছোটনও আসে না। আমাদের তিনবোনের এক সঙ্গে হওয়া হয় না। তুমি কি একটা মজার কথা শুনবে?
শুনব।
কথাটা তোমাকে বলা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছি না। তুমি অন্য কিছু ভাবতে পার। আচ্ছা থাক বলেই ফেলি–আমরা তিনবোন মিলে ঠিক করেছিলাম তিনজন একটা ছেলেকে বিয়ে করব। যাতে সারা জীবন আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি। অদ্ভুত ব্যাপার কী দেখেছ, আমার বড়বোনের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছে, তারপর হলো আমার সঙ্গে। এক সময় হয়তো দেখা যাবে ছোটনের সঙ্গেও তোমার বিয়ে হয়েছে। তুমি আমার কথা শুনে রাগ করছ না তো?
না।
সত্যি রাগ করছ না?
না।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি রাগ করেছ। কারণ তোমার ভুরু কুঁচকে আছে।
আমি রাগ করি নি। বরং খানিকটা মজা পেয়েছি।
তাহলে ভুরু কুঁচকে আছ কেন? মজা পেলে কেউ ভুরু কুঁচকে থাকে না।
ভুরু কুঁচকে আছি কারণ আমি একটা বইয়ের নাম মনে করার চেষ্টা করছি। বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস। সেখানে তিনবোন একটা ছেলেকে বিয়ে করে।
দস্তা-কন্যা হাসিমুখে বলল, বইটার নাম ‘ইছামতি। তোমার কি তিন বোনের নাম মনে আছে? ওদের নাম তিলু, বিলু, নীলু। এখন দয়া করে তোমার ভুরু ঠিক কর। ভুরু কুঁচকে আছে এমন মানুষ দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে। কারণ কী জানো? কারণ আমার বাবা সারাক্ষণ ভুরু কুঁচকে থাকেন। তাকে দেখে। মনে হয় তিনি শুধু যে জগৎ-সংসারের উপর বিরক্ত তা না, তিনি পুরো সৌরমণ্ডলের উপর বিরক্ত। এই, চা খাবে?
না।
খাও না একটু চা। আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে। আমরা তিনবোন যখন গল্প করে রাত কাটাতাম তখন ঘনঘন চা খেতাম। চা বানাব?
বানাও।
তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি চা বানাব, তুমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। তুমি বোধহয় জানো না আমার সারাক্ষণ তোমার পাশে থাকতে ইচ্ছে করে। কিছুক্ষণ তোমাকে না দেখলে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?
হ্যাঁ।
না, তুমি বিশ্বাস করছ না। তুমি অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে আছ।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, দস্তা-কন্যার চোখ পানিতে ভরে গেছে। শুধু তাই না–ইজিচেয়ারের হাতলে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়ল। আমি আবার ভুরু কুঁচকে ফেললাম। চোখের পানি নিয়ে টেনিসনের বিখ্যাত কবিতা আছে। কবিতাটা মনে করার চেষ্টা করছি–
Come not, when I am dead,
To drop thy foolish tears upon my grave.
আমার মৃত্যুর পর তুমি এসো না,
তোমার নির্বোধ অশ্রু আমার কবরে যেন না পড়ে।
স্বামীর সংসার হাতে নেয়ার প্রবল বাসনা
বিয়ের পর মেয়েদের ভেতরে স্বামীর সংসার হাতে নেয়ার প্রবল বাসনা দেখা যায়। মহানন্দে তারা সংসারের দায়িত্ব নিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। কী বাজার হবে, কী রান্না হবে তা নিয়ে মহা ব্যস্ততা। জানালায় নতুন পর্দা লাগানো। টিভিটা সরিয়ে নতুন জায়গায় রাখা। কাজের লোক দিয়ে বাথরুমের কমোড ঘষাঘষি করানো। সব কিছুতেই উৎসাহ।
দস্তা-কন্যার ভেতর সে-রকম কিছুই দেখা গেল না। সে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছে আমার পেছনে। আমি বারান্দায় গেলে সেও বারান্দায়। আমি ছাদে গেলে সেও ছাদে।
আমি বিকেল থেকে আমাদের বাড়ির পেছনের লেবুবাগানে কাজ করছি, সেও মোড়া পেতে আমার পাশে বসে আছে। লেবুবাগানে কাজ করার বিষয়টা আপনাকে বলি। আমি একটা অ্যাক্সপেরিমেন্টাল লেবুবাগান করেছি। সেখানে বারটা কাগজি লেবুর গাছ আছে। গাছগুলির তিনটা গ্রুপ করেছি। প্রতিটি গ্রুপে চারটা করে গাছ। একটা গ্রুপকে স্বাভাবিকভাবে বড় হতে দেয়া হচ্ছে। আরেকটা গ্রুপে কোনো পাতা গজাতে দেয়া হচ্ছে না। পাতা হওয়া মাত্র ছিড়ে ফেলা হচ্ছে। এই গ্রুপের চারটা গাছই পুরোপুরি পত্রশূন্য। আরেকটা গ্রুপে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে। গরম বাতাস দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন বিকেলে এদেরকে দু’ঘণ্টা গরম বাতাস খাওয়ানো হয়। তিনটা গাছেই ফুল ফুটেছে। আমি দেখতে চাচ্ছি কোন গাছের লেবু কেমন হয়।
দস্তা-কন্যা খুব আগ্রহ নিয়ে আমার কর্মকাণ্ড দেখছে। এক সময় সে বলল, এগুলি কেন করছ?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সময় কাটানোর জন্যে করছি।
তোমার কি সময় কাটে না?
কাটে, তবে ভালোভাবে কাটে না।
তোমার কি কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করে না?
না।
আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেতে ইচ্ছা করে না?
মা। তাছাড়া আমার তেমন আত্মীয়স্বজন নেই। আমাদের পরিবারের নিয়ম হচ্ছে, এই পরিবারের লোকজন বেশিদিন বাঁচে না। সামান্য অসুখেই এদের খেল। খতম হয়ে যায়। সর্দি জ্বর, ডায়েরিয়ার মতো নির্দোষ রোগে আমার দু’বোন মারা গেছে।