কোলের উপর রাখা বই পড়ছি। প্রতি মুহূর্তে ভাবছি মেয়েটি আবারো আসবে। সে এলো না। আমি বইটা ইজিচেয়ারে রেখে ঘুমুতে গেলাম। যদি ঘুম আসে–আবারো বই পড়তে আসব।
দস্তা-কন্যা ঠিক আগের ভঙ্গিতেই ঘুমুচ্ছে। ভালো করে লক্ষ করে দেখি, তার হাতভর্তি কাচের চুড়ি। যে চুড়ি পছন্দ করে না সে হঠাৎ করে হাতভর্তি চুড়ি কেন পরল? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। বাতি নিভিয়ে আমি কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। চেষ্টা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ব।
একটু আগে যে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেছি সে আর কেউ না–সে আমার মস্তিষ্কের কল্পনা। আমি নিজে আমার নিজের সঙ্গে কথা বলেছি। মেয়েটির হাতভর্তি চুড়ি দেখেছি–এরও একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে। দস্তা-কন্যা আজ চুড়ি পরেছে। আমার চোখে তা পড়েছে। অস্পষ্টভাবে পড়েছে। চুড়ির টুংটাং শব্দ কানে এসেছে। মস্তিষ্ক টুং টাং শব্দের অংশটা স্মৃতিকোষে জমা করে রেখেছে। সে এই শব্দ নিয়েই খেলা করেছে।
মানুষের মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে, বিভিন্ন স্মৃতিকোষে জমা করে রাখা স্মৃতি নিয়ে নিজের ইচ্ছামতো ঘটনা সাজায় এবং স্মৃতির ফাক ভর্তি করে। একে বলে কনফ্যাবুলেশন, বাংলায় ‘মিথ্যা-স্মরণ’। সাইকোসিসের রোগের শুরুটা হয় এইভাবে। এক পর্যায়ে সে বাস্তবের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক হারিয়ে মনগড়া জগতে বাস করতে থাকে।
আমার বেলাতেও হয়তো এরকম কিছু ঘটবে। আমি দস্তা-কন্যা এবং কাঁসাকন্যা দুজনের সঙ্গে জীবনযাপন করতে থাকব। দু’জনের ভেতর থেকে একজনকে বেছে নেব। সেই একজন দস্তা-কন্যা হতে পারে, আবার কাসাকন্যাও হতে পারে।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ঘুম আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শুধু শুধু বিছানায় গড়াগড়ির কোনো মানে হয় না। বরং বইটা পড়া যেতে পারে। বই পড়ার সময় কাঁসা-কন্যা যদি উপস্থিত হয় তাহলেও মন্দ হয় না।
লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে আমাকে ধাক্কার মতো খেতে হলো। ইজিচেয়ারে রাখা বইটা নেই। বইটা শেলফে সাজিয়ে রাখা।
কাজটা কে করেছে? দোতলায় কেউ আসে না। এই নিয়ম অনেক দিনের। কাজের মানুষরা কেউ এ নিয়ম ভাঙবে না। তাহলে ইজিচেয়ার থেকে বইটা নিয়ে শেলফে কে রাখল? কাঁসা-কন্যা? না-কি এই কাজটা আমি নিজেই করেছি! তারপর ভুলে গেছি। এই স্মৃতি মস্তিষ্কে নেই।
মস্তিষ্ক কিছু কিছু স্মৃতি মুছে ফেলছে। সে এই কাজ যখন করা শুরু করবে তখন থেমে থাকবে না। স্মৃতি মুছবে, স্মৃতি এলোমেলো করে সাজাবে।
আমি ইজিচেয়ারে বসলাম। এবার আমার হাতে বই নেই। চুপচাপ বসে থাকার জন্যেই বসে থাকা। আমার শীত শীত লাগছে। শীত লাগার কি কথা? না-কি শারীরিক অনুভূতির ব্যাপারেও সমস্যা দেখা দিয়েছে?
তুমি এখানে কী করছ?
কাঁসা-কন্যার গলা। সে ঠিক আগের মতো পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম না। যেভাবে বসেছিলাম সেভাবেই বসে রইলাম। আমার দৃষ্টি শেলফে রাখা বইটার দিকে।
কাঁসা-কন্যা আবারো বলল, তুমি কী করছ?
বই পড়ছি।
তোমার হাতে তো বই নেই। বই পড়ছ কীভাবে?
ও আচ্ছা তাই তো! বই পড়ব বলে ভাবছি। তুমি কি নীল রঙের ঐ বইটা এনে দেবে? শেলফ থেকে একটু বের হয়ে এসেছে।
কাঁসা-কন্যা ইজিচেয়ারের পেছন থেকে সামনে চলে এলো। আমি দেখলাম কাঁসা-কন্যা না। যে আমার সামনে এসেছে সে রূপা, আমাদের দস্তা।
সে বই এনে আমার হাতে দিতে দিতে বলল, ঘুম ভাঙার পর খুব ভয় পেয়েছি।
কেন?
তুমি পাশে নেই, আমি ভয় পাব না? তোমাদের এই বিশাল বাড়ি। সারাক্ষণই এদিকে ওদিকে ভৌতিক শব্দ হয়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তুমি কি রাতদুপুরে সত্যি সত্যি বই পড়বে?
পড়ব।
তাহলে আমি তোমার পাশে বসে থাকি। আমি একা শুয়ে থাকতে পারব না।
দস্তা শোন, তোমার একা শুয়ে থাকার অভ্যাস করতে হবে। আমি প্রায়ই ছাদে চলে যাই। ছাদে পাটি পেতে শুয়ে থাকি।
কেন?
আমার কিছু বিচিত্র অভ্যাস আছে। বিচিত্র অভ্যাসের একটি হলো, ছাদে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থেকে আকাশের তারা দেখা।
তুমি যখন ছাদে যাবে অবশ্যই ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে। আমিও ছাদে তোমার সঙ্গে শুয়ে থাকব। তারা দেখব।
আমি চুপ করে থাকলাম। দস্তা আগ্রহের সঙ্গে বলল, এখন ছাদে যাবে? চল যাই।
আমি বললাম, এখন যেতে ইচ্ছা করছে না।
দস্তা বলল, ইচ্ছা না করলে যেতে হবে না। এখন কি তোমার বই পড়তে ইচ্ছা করছে?
আমি বললাম, আমার ঠিক কী ইচ্ছা করছে বুঝতে পারছি না।
দস্তা বলল, আমার কী ইচ্ছা করছে বলব?
বলো।
আমার ইচ্ছা করছে তোমার সঙ্গে গল্প করতে। তোমার যেমন রাতে ঘুম ভেঙে গেলে একা একা ছাদে চলে যাবার অভ্যাস, আমারও সে-রকম গল্প করার অভ্যাস।
কার সঙ্গে গল্প করতে?
সাথী আপার সঙ্গে। আমরা তিনবোন বড় একটা খাটে এক সঙ্গে ঘুমোতাম। আমি মেজ বলে আমি মাঝখানে, বাকি দুজন দু’পাশে। গরমের সময় মাঝখানে শুলে চাপাচাপি হয়। এই জন্যে পরে ঠিক করা হলো–ঘুমুতে যাবার আগে লটারি করা হবে। লটারিতে যার নাম উঠবে সে শুবে মাঝখানে। আমার এমনই কপাল যে লটারিতে সবসময় আমার নাম উঠত। আচ্ছা আমি যে বকবক করছি তুমি বিরক্ত হচ্ছ না তো?
না।
এখন বিরক্ত না হলেও পরে হবে। আমি যে কী পরিমাণ কথা বলতে পারি তুমি জানো না। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে আমার নাম ছিল—‘কথা সাগর’। সেকেন্ড ইয়ারে নাম হয়ে গেল—‘কথা মহাসাগর’।
আমি তাকিয়ে আছি দস্তা-কন্যার দিকে। সে ইজিচেয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছে। তার হাত ইজিচেয়ারের হাতলে। চোখ বড় বড় করে গল্প করছে–দেখতে ভালো লাগছে।