যাই হোক, ক্রিস্টিনা রোসেটির কবিতার অনুবাদ কেমন হয়েছে দেখুন তো–
মৃত্যুর মতো প্রগাঢ় প্রেম কিন্তু মৃত
এসো সেই শবদেহের জন্যে একটা বিছানা করি।
ছড়িয়ে দেই কিছু শুকনো ফুল,
একটা সবুজ চাদর থাকুক তার মাথার পাশে
আর পায়ের কাছে একটা প্রস্তরখণ্ড।
আমরা দু’জন বসব সেই পাথরে।
কাটিয়ে দেব অলস বিকেলের শান্ত সময়।
ভাই, কী বললেন, আবার বলুন, আমি বুঝতে পারি নি। ও আচ্ছা আচ্ছা যে সমস্যা সমাধানের জন্যে বিয়ে করেছি সেই সমস্যার সমাধান হয়েছিল কি না। বিয়ের পরেও নারীকণ্ঠ শোনা যেত কি যেত না। তাই তো?
না, সমস্যার সমাধান হয় নি। হঠাৎ হঠাৎ নারীকণ্ঠ শুনতাম। বিয়ের পর প্রথম যেদিন নারীকণ্ঠ শুনলাম সেদিনের কথা বলি। দস্তা-কন্যা ঢুকেছে। বাথরুমে। শাওয়ার ছেড়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে সে গোসল করবে। আমি বসে আছি বারান্দায় বানরগুলির জন্যে অপেক্ষা করছি। কিংবা অপেক্ষা ছাড়াই বসে আছি। হাতে বই আছে। ইচ্ছা হলে দু’এক পাতা পড়ব, ইচ্ছা না হলে পড়ব না। সময় কাটছে আরামদায়ক আলস্যে। ক্রিস্টিনা রোসেটির কবিতার মতো—‘কাটিয়ে দেব অলস বিকেলের শান্ত সময়’।
তখন খুব কাছ থেকে কে যেন বলল, কী করছেন? আমি এতই চমকালাম যে হাত থেকে বই পড়ে গেল। ভয়ঙ্করভাবে চমকানোর প্রধান কারণ হলো–নারীকণ্ঠটা এখন চেনা। দস্তা-কন্যার গলা এবং এতে কোনো ভুল নেই। দস্তাকন্যা বাসররাতে আমার সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বললেও এখন ‘তুমি’ করে বলে। নারীকণ্ঠ বলছে ‘আপনি’ করে। প্রভেদ বলতে এইটুকুই।
আমি সারা বিকাল ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে সন্ধ্যা নাগাদ একটা মোটামুটি সমাধান দাঁড় করিয়ে ফেললাম। আমি আমার সমাধানটা আপনাকে বলছি। এই বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে সেটা পরে শুনব।
আমার ব্যাখ্যা হলো মানুষের মস্তিষ্ক অপরিচিত কোনো জিনিস বেশিক্ষণ সহ্য করে না। নানানভাবে সে চেষ্টা করে অপরিচিত জিনিসটাকে পরিচিত করতে। একটা লম্বা দাগের দু’পাশে দু’টা ফুটা আঁকলে মস্তিষ্ক সেটাকে মানুষের আদল দিতে চেষ্টা করে। আমার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটছে। তরুণী-কণ্ঠকে সে পরিচিত করার ব্যবস্থা করছে।
তরুণী-কণ্ঠ দ্বিতীয়বার শুনলাম এক মধ্যরাতে। হঠাৎ পানির পিপাসায় ঘুম ভেঙে গেছে। দস্তা-কন্যা হাত-পা গুটিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে। আমি খুব সাবধানে তার ঘুম না ভাঙিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। পাশের ঘরে গেলাম। ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করে পর পর দু’গ্লাস বরফ-শীতল পানি খেলাম। হঠাৎ করে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পানি খাওয়ার জন্যেই হয়তো ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাবার পর যদি ঘুম না আসে, তাহলে বেশিরভাগ মানুষই খুব আপসেট হয়ে পড়ে। আমার কিন্তু ভালোই লাগে। নীরব সুনসান রাতে চুপচাপ বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ। দিনের বেলায় হৈচৈ কোলাহলে জেগে থাকার চেয়ে রাতের জেগে থাকা শ্রবণেন্দ্রিয়ের জন্যে আনন্দময়। মানুষের কান পঁয়ত্রিশ ডেসিবেলের চেয়ে উঁচু শব্দ শুনলে কষ্ট পায়। রাতের বেলায় শব্দমাত্রা নিশ্চয়ই পঁয়ত্রিশ ডেসিবেলের নিচে।
আমি লাইব্রেরি ঘরে ঢুকলাম। শেলফের কাছে গিয়ে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ালাম। যে বইটা হাত দিয়ে প্রথম ছোঁব সেটাই পড়ব। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে যে পড়া ধরব তা না। ইজিচেয়ারে শুয়ে বই খুলব (চোখ তখনো বন্ধ)। যে পৃষ্ঠাটা খোলা হবে সেখান থেকেই পড়া শুরু করব। এটা আমার একটা খেলা। শিশুরা যেমন বড়দের মতো কিছু খেলার চেষ্টা করে, বড়রাও সে-রকম শিশুদের কিছু খেলা খেলে।
বই পড়তে শুরু করেছি। হাতে এসেছে মার্কেজের লেখা ‘দ্য স্টোরি অফ এ শিপরেকড সেইলার’-এর ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন- রেনডলফ হোগান। বই পড়তে যাব, তখন নারীকণ্ঠ শুনলাম–ঘুমাচ্ছেন না কেন?
আমি অন্যদিনের মতো এদিক ওদিক তাকালাম না। চোখ বন্ধ করে বললাম, ঘুম আসছে না, তাই ঘুমাচ্ছি না। বলেই অপেক্ষা করতে লাগলাম কী জবাব আসে তা শোনার জন্যে। কোনো জবাব এলো না। আমি যখন মোটামুটি নিশ্চিত যে জবাব আসবে না, তখন পায়ের শব্দ শুনলাম। কেউ যেন এগিয়ে আসছে। এই তো লাইব্রেরি ঘরে ঢুকল। এগুচ্ছে আমার দিকে। এই তো আমার ইজিচেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখার। অনেক কষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করলাম। যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে দেখি সে কথা বলে কি-না।
সে কথা বলল। অবিকল দস্তা-কন্যার গলায় কিছুটা আদুরে ভঙ্গিতে বলল, কী পড়ছেন?
বই।
কী বই?
দ্য স্টোরি অফ এ শিপরেকড সেইলার।
শব্দ করে পড়ন না। আমিও শুনি।
তুমি কে?
নারীকণ্ঠ জবাব দিল না। খিলখিল করে হাসল। সে সম্ভবত হাত নাড়িয়েছে। কারণ তার হাতে চুড়ির শব্দ শুনলাম। কাচের চুড়ি। এটা একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য। দস্তা-কন্যা কাচের চুড়ি, সোনার চুড়ি–কোনো চুড়িই পরে না। চুড়ির টুং টাং শব্দ তার ভালো লাগে না।
তোমার নাম কী?
(আবারো হাসি)
হাসছ কেন?
নাম জিজ্ঞেস করছি, নাম বলো।
আমার নাম কাঁসা।
কাঁসা মানে?
কাঁসা চেনেন না? তামা এবং দস্তা মিলিয়ে হয় কাঁসা। (আবারো হাসি)
আমি যদি এখন পেছন দিকে ফিরি, তাহলে কি তোমাকে দেখতে পাব?
দেখতে পেতেও পারেন, আবার নাও পেতে পারেন। (হাসি)
আমি সাবধানে চোখ খুললাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। পেছনে কেউ নেই। শুধু দরজার পর্দা কাঁপছে। বলাই বাহুল্য, বাতাসে কাঁপছে। তবে কেউ যদি ভাবতে চায় কাঁসা নামের মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে পর্দা সরিয়ে এই দরজা দিয়ে চলে গেছে–তাও ভাবতে পারে।