দীপু কথাটা মনে রেখেছে। এর পরে সে কখনও কাউকে কিছু নিয়ে নালিশ করেনি। কাজেই এবারেও হেডস্যারের কাছে নালিশ করার বুদ্ধিটা সে সোজাসুজি বাতিল করে দিল। কিন্তু তার বদলে কী করা হবে সেট বলে দেয়া এত সহজ হল না।
সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ঠিক তক্ষুনি দীপুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ক্লাসের সবাই, সম্ভব না হলে বেশির ভাগ ছেলেদের রাজি করাতে পারলেই সে তার বুদ্ধিটা কাজে লাগাতে পারে। প্রথমে একজন দুজন, আস্তে আস্তে সবাই রাজি হয়ে গেল। পরের বুধবারের জন্যে তখন দীপু অপেক্ষা করতে লাগল খুব আগ্রহ নিয়ে।
বুধবারের ড্রিল ক্লাসে ড্রিল-স্যার সেদিনও সবাইকে লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে বলে দিয়েছেন, আজ শেষ পাঁচজন। স্যার যদি একটু লক্ষ্য করতেন তা হলে দেখতেন, ছেলেদের ভেতর আজ আর ভয়ের ভাবটা নেই, বরং একটু উত্তেজনা। সবার চোখ চকচক করছে।
স্যার বাঁশিতে ফু দিলেন, অন্য দিনের মতো সবার প্রাণপণে ছুটে যাবার বদলে আজ একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। সবাই মিলে এক লাইনে আস্তে আস্তে দৌড়াতে লাগল। প্রথমে একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল কিন্তু কিছুক্ষণেই সবাই লাইন ঠিক করে ফেলল। তারিক এবং আরও দু-একজন শুধু প্রাণপণে ছুটে যাচ্ছিল, দীপু জানত ওরা যাবে। কিন্তু যখন দেখল অন্যরা সত্যি এক লাইনে ছুটে যাচ্ছে, তখন আর একা দৌড়াতে ভরসা পেল না, তারিক এবং আর বাকি তিনজনও ফিরে এসে লাইনে মিশে গেল। তখন দীপুর ফুর্তির সীমা থাকল না।
ড্রিল-স্যারের বিস্ফারিত চোখের সামনে চল্লিশজন এক লাইনে তালে তালে পা ফেলে দেয়াল ছুঁয়ে আবার তালে তালে পা ফেলে ফিরে আসতে লাগল। এমন শৃঙ্খলা কখনও দেখা যায় না, রাস্তায় লোকজন দাঁড়িয়ে গেল মজা দেখতে। দৌড় শেষ হবার সময় সবাই দু’পাশে তাকিয়ে লাইন ঠিক করে নিল, আর দীপু যেরকম চেয়েছিল ঠিক সেরকম করে একসাথে লাইনে পা দিয়ে কয়েক পা ছুটে থেমে গেল।
আজ আর কেউ এগিয়ে যায়নি, কেউ পিছিয়েও পড়েনি, এবারে দেখা যাবে শেষ পাঁচজন কীভাবে বেছে নেন।
স্যার লম্বা লাইনটির দিকে তাকালেন, রাগে তাঁর মুখ থমথম করছে! হাতের বেতটি মুচড়িয়ে এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, এটা কার বুদ্ধি?
কেউ কোনো কথা বলল না।
কার বুদ্ধি এটা? প্রচণ্ড ধমকে অনেকে কেঁপে উঠল এবার, তবুও কেউ কোনো কথা বলল না। স্যারের মুখ অপমানে কালো হয়ে উঠল। দাঁত চিবিয়ে বললেন, যদি না বলিস তা হলে একধার থেকে মারতে শুরু করব। এমন মার মারব যা কোনোদিন দেখিসনি। এক মিনিট সময় দিলাম–
ভয়ের একটা কাঁপুনি দীপুর মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল। ও বুঝতে পারল এক মিনিট পর সত্যি স্যার একধার থেকে মারতে শুরু করবেন। দীপু ভেবেছিল ক্লাসের সব ছেলেকে কোনোদিন মারা সম্ভব না, তাই কাউকে মারবেন না। কিন্তু এখন দেখল এই স্যারের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব।
এক মিনিট পর আমি মারতে শুরু করব, এখনও বল কার মাথা থেকে এটি বেরিয়েছে। কে এই বুদ্ধি বের করেছিস এক পা এগিয়ে আয়। কেউ কোনো কথা বলল না। কয়েকজন আড়চোখে দীপুকে দেখার চেষ্টা করল।
দীপু ঠিক করল, ও স্বীকার করে নেবে। বুদ্ধিটা ওর, ওর একার জন্যে সবাইকে মার খাওয়ানো ঠিক হবে না। খামোকা পাঁচজনের মার খাওয়া বন্ধ করতে গিয়ে সবাইকে মার খাওয়ানো শুরু করিয়ে লাভ কী? দীপু শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে অল্প অল্প কাঁপতে লাগল।
এগিয়ে আয় এক পা, স্যার আবার চিৎকার করে উঠলেন।
দীপু এক পা এগিয়ে গেল, ওর মুখ ফ্যাকাসে, পা কাঁপছে থরথর করে। সহ্য করতে পারবে তো মার? কেঁদে ফেলবে না তো যন্ত্রণায়?
লাইনে বাকি ছেলেগুলো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ টিপু ছটফট করে উঠল। তারপর এক পা এগিয়ে এসে দীপুর পাশে দাঁড়াল। টিপুর দেখাদেখি কমল আর সাজ্জাদও এগিয়ে আসে সামনে। আর তাদের দেখাদেখি হঠাৎ পুরো ক্লাস এক পা এগিয়ে দীপুর দু’পাশে সারি বেঁধে দাঁড়াল। তারিক একা একা শুধু আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর সেও সাবধানে এগিয়ে এসে লম্বা লাইনে মিশে গেল।
দীপু দু’পাশে তাকাল—তার কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দু’পাশে চল্লিশজন ছেলের লম্বা সারি, সবাই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কোনো কথা বলছে না। কিন্তু দীপু বুঝতে পারছে ওরা কেউ ওকে একা মার খেতে দেবে না! ওর বুকের ভেতর জানি কেমন করে ওঠে, চোখে পানি এসে ঝাঁপসা হয়ে যায় সবকিছু।
সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, স্যার কাউকেই মারলেন না। অনেকক্ষণ ওদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর বেতটা ছুঁড়ে ফেলে পুরো ক্লাসটা ছুটি দিয়ে দিলেন। ওরা ফিরে যেতে যেতে দেখল, স্যার একা মাঠের মাঝে চুপচাপ বসে বসে সিগারেট খাচ্ছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। মনে হচ্ছে অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন হঠাৎ করে।
এর পরেও স্যার মাস তিনেক ছিলেন স্কুলে, তারপর রিটায়ার্ড করে চলে গেলেন। এর মাঝে একবারও নাকি একটি ছেলেকেও মারেননি।
৩. ক্লাস নাইনের সাথে ফুটবল খেলা
ক্লাস নাইনের সাথে ফুটবল খেলায় কে ক্যাপ্টেন হবে সেটা নিয়ে ক্লাসের পর আলোচনা হচ্ছিল। তারিকের লজ্জাশরম বরাবরই কম। সে সোজাসুজি ক্যাপ্টেন হতে চাইল। দীপু আপত্তি করে বলল, যে সবচেয়ে ভাল খেলে—রফিক, সে হবে ক্যাপ্টেন। রফিক ভয়ে ভয়ে বলল, তার ক্যাপ্টেন হবার ইচ্ছে নেই, তারিকই হোক!