এর পরের ক’দিন তারিক ওকে এড়িয়ে গেল, দীপুও আর নিজে থেকে কিছু বলল না। আবার তারিকের সাথে ওর গন্ডগোল লাগল ড্রিল ক্লাসে। প্রতি বুধবার বিকেলে ড্রিল ক্লাস, বরাবর সে দেখে এসেছে ড্রিল ক্লাস হয় সবচেয়ে মজার—লাফ ঝাঁপ হৈচৈ ফুর্তি, অথচ এখানে দেখল ড্রিল ক্লাসে যাবার আগে সবার চোখমুখ। শুকিয়ে গেছে। বাবুর কাছে শুনতে পেল ড্রিল-স্যারটি নাকি আগে মিলিটারিতে ছিলেন, আর ছেলেদের একবারে মিলিটারিদের মতো খাঁটিয়ে নেন, মারপিট করেন ইচ্ছেমতো। মার খেতে কখনও ভাল লাগে না, কিন্তু ড্রিল ক্লাসে মারপিট করার সুযোগটা হয় কীভাবে সেটা দীপু বুঝতে পারল না। এখানে তো আর বাড়ির কাজ বা পড়া মুখস্থ নেই।
ব্যাপারটা বুঝতে পারল একটু পরেই। ড্রিল-স্যার মাঠে রোদের মাঝে সবাইকে লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, এক দৌড়ে ঐ দেয়াল ছুঁয়ে ফিরে আসবে। আজকে শেষ দশজন।
দীপু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, শেষ দশজন মানে?
শেষ দশজন পিটুনি খাবে। অন্য সময় শেষ পাঁচজন খেত। তুমি দৌড়াতে পার তো?
দীপু মাথা নাড়ল।
হুঁ বাবা-দৌড়াতে না পারলে বেতের বাড়ি খেতে হবে।
ড্রিল-স্যার হুইসেল দিতেই সবাই প্রাণপণে ছুটতে লাগল। দেয়ালটি মাঠের আরেক মাথায়। ছুটতে ছুটতে দম বেরিয়ে যেতে চায়। দীপু মোটামুটি প্রথম দিকেই ছিল, কিন্তু হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পা বেঁধে পড়ে গেল। মাটিতে আছড়ে পড়ার আগের মুহূর্তে দেখল তারিক হলুদ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ওর ওপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে পা বাধিয়ে সে-ই দীপুকে ফেলে দিয়েছে।
দীপু বুঝতে পারছিল ও যদি উঠে আবার দৌড়াতে শুরু না করে তা হলে বেত খেতে হবে, কিন্তু এমন লেগেছে পায়ে যে, ওঠার শক্তি নেই। চোখে পানি এসে যাচ্ছিল যন্ত্রণায়। কোনোমতে সামলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল, তারপর পা টেনে টেনে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও সে পারল না, শেষ দশজনের ভেতর থেকে গেল।
প্রচণ্ড মারতে পারেন ড্রিল-স্যার। দীপু বেশ শক্ত ছেলে, তবু ওর চোখে পানি এসে গেল প্রায়। ওর নিজের থেকে বেশি খারাপ লাগল টিপু আর সাজ্জাদের জন্যে। টিপু ফার্স্ট বয়। খুব ভাল ছেলে, কিন্তু দৌড়াতে পারে না ভাল, কাজেই প্রতি বুধবারে স্যার ওকে পিটিয়ে সুখ করে নেন। সাজ্জাদের কথা আলাদা; এত দুর্বল যে, ওর দৌড়ানের কোনো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু ড্রিল-স্যার কিছুই শুনবেন না।
পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ড্রিল ক্লাসটি মনে হল পঁয়তাল্লিশ ঘণ্টা লম্বা। ক্লাসের শেষে সবাই একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। ছুটির ঘণ্টা যখন পড়ল তখন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আছাড় খেয়ে দীপুর পায়ে বেশ লেগেছে, ছুটির পর ও যখন বাসায় ফিরে যাচ্ছিল তখন সে অল্প অল্প খোঁড়াচ্ছে।
রাস্তার মোড়ে ওর তারিকের সাথে দেখা হল। হাতে একটা সিগারেট আড়াল করে ধরে রেখেছে। ওকে দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল, কীরে বুক বাইন্ডার!
দীপু কথা না বলে হেঁটে যেতে লাগল। তারিক এদিক সেদিক তাকিয়ে সিগারেটে দুটি লম্বা টান দিয়ে সিগারেটটি ফেলে দিয়ে ওর পাশে পাশে হেঁটে যেতে থাকে। ইচ্ছে করে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, কীরে আমার কয়টা বই বাইন্ডিং করে দিবি?
দীপু অনেক কষ্ট করে সহ্য করে যাচ্ছিল। যদিও ভেতরে ভেতরে ও রাগে ফেটে পড়তে চাইছিল, তবুও ঠান্ডা গলায় বলল, দেব।
কত করে পয়সা নিবি?
পয়সা নেব না।
ফ্রী করে দিবি? কেন ফ্রী করে দিবি?
এমনি।
এমনি বুঝি কেউ বই বাইন্ডিং করে দেয়? আমি কি তোর ইয়ে নাকি যে ফ্রী করে দিবি?
দীপুর মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। দাঁড়িয়ে পড়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে তারিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, শোন তারিক, তুই কি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাস?
তারিক একটু থতমত খেয়ে বলল, কেন? ঝগড়া করতে চাই কে বলল?
তা হলে এরকম করছিস কেন? তুই দৌড়ের মাঠে আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে মার খাইয়েছিস। এখন আবার আজেবাজে কথা বলে আমাকে খ্যাপাতে চাইছিস? কেন? মারামারি করবি আমার সাথে?
খুব যে চোখ লাল করছিস আমার উপরে?
দ্যাখ তারিক; আমাকে টিপু, সাজ্জাদ বা বাবু পাসনি যে তুই যা ইচ্ছে বলবি, আর আমি চুপ করে থাকব। যদি আমার সাথে মারামারি করতে চাস, আয়, আমি কাউকে ভয় পাই না। আর যদি না চাস, সোজা তুই তোর বাসায় যা, আমি আমার বাসায় যাই।
দীপু খুব যে একটা মারপিট করে অভ্যস্ত তা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সে যেরকম জোর গলায় তারিককে সাবধান করে দিল যে, তারিক আর ওকে ঘটাতে সাহস করল না। মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, খুব উঁট মারছিস? এমন ধোলাই দেব একদিন যে বাপের নাম ভুলে যাবি।
আজকেই দে-না, এখনই দে-না।
তারিক খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হেঁটে পাশের গলিতে ঢুকে গেল।
বাসায় ফিরে যেতে যেতে দীপু বুঝল, ব্যাপারটা ওর জন্যে বেশি ভাল হল না, কিন্তু ওর কিছু করার ছিল না।
২. দীপুর সাথে তার আব্বার সম্পর্ক
দীপুর সাথে তার আব্বার সম্পর্ক একটু অদ্ভুত। মোটেই অন্য দশজন আব্বা আর তাদের ছেলের মতো নয়। দীপু তার আব্বার সাথে এমনভাবে কথা বলে যেন তিনি তার ক্লাসেরই একটি ছেলে। নিজের আম্মাকে কখনও দেখেনি, আব্বাই তাকে বড় করেছেন একেবারে ছেলেবেলা থেকে। কাজেই দীপুর আব্বাই তার সবচেয়ে বড় বন্ধু।