ভেতর থেকে একটা গালির, আরেকটা গুলির শব্দ শোনা গেল। নিশ্চয়ই ওপর দিকে গুলি করছে, কিন্তু লাভ কী?
দীপু স্ফুর্তিতে চুপ করে বসে থাকতে পারছিল না। বারবার তাকাচ্ছিল পুলিশ আসছে কি না দেখতে। পুলিশ এসে গেলেই নিশ্চিত হয়। বিলু বুদ্ধি করে, প্রথমেই ওর আব্বার কাছে গেলে হয়।
ভাল করে চারদিকে তাকিয়ে দীপু বুঝতে পারল সকাল হয়ে আসছে। ওর সাহস বেড়ে গেল সাথে সাথে একশো গুণ। রাত শেষ হয়ে গেলেই বুঝি সাহস বেড়ে যায়। দীপুর মজা করার ইচ্ছে হল একটু। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, মূর্তি চোরারা তোমাদের বাড়ি কোথায়?
ভেতর থেকে কোনো উত্তর এল না। তারিক বলল, ভয় করছে নাকি?
ভয় না ভয় না, লজ্জা।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ভেতর থেকে হঠাৎ লোকটি ভাঙা গলায় কথা বলে উঠল, কী চাও তোমরা? কী জন্যে আটকে রেখেছ আমাদের?
মিঠু বলল, কাবাব বানাব তোমাদের।
বাবু সাথে সাথে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিল, থিফ ফ্রাই।
ইয়েস, উই উইল মেক থিফ ফ্রাই এন্ড ইট উইথ পটেটো।
হো হো করে সবাই আবার হেসে উঠল। হাসি থামার সাথে সাথে শুনল, লোকটি বলছে, আমাদের বের হতে দাও, তোমরা যা চাইবে তা-ই দেব।
সত্যি?
সত্যি।
বেশ তা হলে একজন একজন করে পা উপর দিকে তুলে বের হয়ে এসো।
সবাই আবার হেসে ওঠে। অল্পতেই একেকজন কেন জানি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল।
দীপু চেঁচিয়ে বলল, শোনো মূর্তি চোরারা। তোমরা সাহেবকে বলে দাও, পুলিশ আসার পর তোমাদের টাকায় থুথু দিয়ে তোমাদের মুখে ছুঁড়ে দেব
পুলিশ! ভিতর থেকে লোকটার কাতর গলার স্বর শোনা গেল, প্লীজ, পুলিশকে খবর দিও না।
ঠিক তক্ষুণি দূরে একটা জীপের শব্দ শোনা গেল। এই গ্রামের রাস্তায় গাড়ি খুব একটা আসে না, কারও বুঝতে বাকি রইল না পুলিশ আসছে। আনন্দে চিৎকার করে উঠল দীপু, মূর্তি-চোরারা, শুনতে পাও?
কী?
পুলিশের গাড়ির শব্দ? আধ ঘণ্টা আগে তোক চলে গেছে পুলিশ ডাকতে, এতক্ষণ মশকরা করছিলাম তোমাদের সাথে। শালারা ভাবছে টাকার জন্যে! বেকুব কোথাকার-বলে তারিক টাকার বান্ডিল থেকে একটা দশ টাকার নোট সরিয়ে ফেলল। থুথু মেরে দশ টাকা কম ফেরত দিলে এমন আর কি ক্ষতি হবে?
৭. জায়গাটা পুলিশে ভরে গেল
খানিকক্ষণের ভেতরেই জায়গাটা পুলিশে ভরে গেল। বিলু দীপুর আব্বাকে নিয়েই থানায় গিয়েছিল। পুলিশ ইন্সপেক্টরের সাথে দীপুর আব্বাও এসেছেন। ওদের মুখে সব শুনে পুলিশ ইন্সপেক্টর রিভলবার হাতে নিয়ে কালাচিতার মুখে দাঁড়িয়ে এমন চিৎকার করে ধমক দিল যে সুড়সুড় করে সবাই হাত তুলে বের হয়ে এল। বিদেশীটার মাথার বিভিন্ন জায়গা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। যে লোকটা এতক্ষণ কথা বলছিল তার কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। দীপুর ইটের জন্যে সম্ভবত। পোশাক দেখে ওদের তাক লেগে গেল। গলায় টাই পর্যন্ত আছে।
সকাল হয়ে আসছে, আবছা আলোয় চারদিকে এত হৈচৈ, লোকজন, সব কেমন অবাস্তব মনে হয় দীপুর কাছে। সব ভালয় ভালয় শেষ হল তা হলে! সারা রাত জেগে আছে, কিন্তু ঘুম পাচ্ছে না কারও। নান্টুর শুধু শরীর খারাপ হয়ে গেল। বমি করে ফেলল কেন জানি। ওকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল জীপে। হঠাৎ করে ওরা সবাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।
দীপুর ওর আব্বার সামনে যেতে একটু ভয় লাগছিল। আস্তে আস্তে সাহস করে গিয়ে বলল, আব্বা–
কী?
তুমি কি রাগ করেছ আমার উপর?
আব্বা আস্তে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন, হলেই আর কী লাভ, তুই কি আমার কথা শুনিস কখনও। কারও যদি কিছু হতো?
দীপু মাথা নিচু করে বলল, হয়নি তো!
হুঁ, হয়নি। আচ্ছা যা, রাগ করিনি।
সত্যি?
সত্যি। আব্বা ওর মাথায় হাত রাখলেন। হঠাৎ করে মনে হল তাঁর দীপু অনেক বড় হয়ে গেছে। কেন জানি আবার একটা নিঃশ্বাস ফেললেন আস্তে আস্তে।
.
রাতে বাসা থেকে পালিয়েছিল বলে সেবারে আর কারও মার খেতে হয়নি। খবরের কাগজে পরের দিনই সব বের হয়েছিল—ওরা হাসিমুখে বসে আছে, পেছনে হাতকড়া লাগানো মূর্তিচোরের দলের ছবি। খুব হৈচৈ হল কয়দিন। জামশেদ সাহেব তার দলবল নিয়ে জায়গাটা খোঁড়াখুড়ি শুরু করে দিলেন। আব্বার সাথে দেখা হলেই বলতেন তারিক আর দীপু খুঁড়তে চেষ্টা করে জায়গাটার কী কী ক্ষতি করেছে। ওরা যে বের করে দিল সেটি যেন কিছু না।
দীপু ওর আব্বাকে তারিকের কথা আর তার আম্মার কথা খুলে। বলল—কালাচিতা হাতছাড়া হবার পর তারিকের দিকে তাকানো যায় না। ওখানে। গুপ্তধন পাবে সেরকম আশাও আর নেই। আব্বা সব শুনে-টুনে কয়দিন কী যেন করলেন, কোথায় কোথায় চিঠি লিখলেন, কার কার সাথে কথা বললেন। তারপর একদিন তারিককে ডাকিয়ে এনে তার একটি ছবি তুলে নিলেন। দীপু কিছু বুঝতে পারছিল না, আব্বাকে জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ নাই। জিজ্ঞেস করলেই বলেন, উঁহু, বলা যাবে না, টপ সিক্রেট।
টপ সিক্রেট আর বেশিদিন টপ সিক্রেট থাকল না। একদিন খবরের কাগজ খুলেই দীপু অবাক হয়ে দেখল প্রথম পৃষ্ঠাতেই তারিকের ছবি! নিচে লেখা, খুদে নৃতত্ত্ববিদ পুরস্কৃত। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল দীপু—মৌর্যসভ্যতার একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা খুঁজে বের করেছে বলে বাংলাদেশ সরকার তারিককে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছে। তারিকের এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্যে জায়গাটার নাম তারিকের দেয়া কালাচিতাই থাকবে। চিৎকার করে উঠে মুখ না ধুয়েই খবরের কাগজ হাতে খালিপায়ে দীপু ছুটে বেরিয়ে পড়ল। তারিককে খবরটা সে প্রথমেই দিতে চায়।